বর্ষা এলেই প্রকৃতি সাজে নতুন রূপে। গায়ে জড়ানো থাকে সবুজের চাঁদর। বিশেষ করে পাহাড়ে এ পরিবর্তনটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। আর সবুজে মোড়ানো ঢেউয়ের মতো পাহাড়ের রেখা, অবিরাম ঝর্ণাধারা, আর দুরন্ত বৃষ্টির শব্দ যেন প্রকৃতিপ্রেমীদের ডাকে—‘চলো ঘুরে আসি’। বান্দরবানের আমিয়াখুম, নাফাখুম, রেমাক্রি, আলিকদম, আন্ধারমানিক, সাকা হাফং, তাজিংডং কিংবা রাঙামাটির ধুপপানি—এসব স্থান বহুদিন ধরেই ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যদিও নিরাপত্তা বিবেচনায় কিছু স্থানে প্রশাসন ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে, তবু নানা উপায়ে পর্যটকরা পৌঁছে যাচ্ছে সেসব দুর্গম স্থানে।
সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই চোখে পড়ে ঝর্ণার তাজা জলধারা, দিগন্তজোড়া সবুজ, পাহাড়ি মেঘের খেলা। ক্যাপশন পড়ে মনে হয়—‘আর দেরি নয়, এবার পাহাড়ে যাওয়া চাই’। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে পারে ভয়ংকর ফাঁদ। কারণ পাহাড়ে বর্ষা মানেই ঢল, ভূমিধস, আকস্মিক বন্যা আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া স্রোতের আশঙ্কা। তাই এসব বিষয়ে পর্যটক এবং ট্যুর অপারেটরদের আরও বেশি সতর্ক ও যত্নবান হতে হয়। অন্যথায় ঘটে যেতে পারে নানা দুর্ঘটনা।
গত কয়েকবছর এবং সম্প্রতি এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার খবর মিডিয়ায় উঠে এসেছে।
বর্ষায় অপরূপ রূপে সাজে পাহাড়। এ যেনো মিতালী গড়ে উঠে আকাশ ও পাহাড়ের মাঝে। এই অপরূপ সৌন্দর্যকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুর অপারেটর বা ট্রাভেল গ্রুপ। এদের অনেকেই সেবা ও দায়িত্ববোধ দিয়ে নিজেদের সাক্ষরতার প্রমাণ দিচ্ছে। এমনকি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশি পর্যটকও তাঁদের সেবা নিচ্ছে। এর বিপরীত চিত্রও আবার দেখা যায়। গড়ে উঠেছে কিছু অনিরাপদ, অনভিজ্ঞ ট্যুর অপারেটর ও তথাকথিত ‘গাইড’— যারা পাহাড়ে বা দুর্গম কোন স্থানে পর্যটক পাঠাচ্ছে। এদের অনেকেরই নেই বৈধ লাইসেন্স, নেই পাহাড়ের প্রতি মৌসুমি আচরণের জ্ঞান, নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পরিকল্পনা। এমনকি যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন- লোকাল গাইড, তাও নেয়া হচ্ছে না। অথচ বিজ্ঞাপন দিচ্ছে—‘৭ দিনে আমিয়াখুম’, ‘কম খরচে আন্ধারমানিক’— এমন লোভনীয় ট্যুর প্যাকেজ।
পর্যটকদের শারীরিক সক্ষমতা, পূর্ব অভিজ্ঞতা, আবহাওয়া সতর্কতা—কোনো কিছুই এদের মাথাব্যথা নয়। তাঁরা চায় যত দ্রুত সম্ভব ট্যুর প্যাকেজটি কিভাবে সম্পন্ন করা যায়। তাই ঝড়, বৃষ্টি, ঢল, ভূমিধসের আশঙ্কা উপেক্ষাকরেই শুরু হয় যাত্রা। বিপদ হলে সেখানেই শুরু হয় ট্র্যাজেডির গল্প।
সম্প্রতি বান্দরবানের শামুকঝিরি ঝরনার ঢলে প্রাণ হারিয়েছেন দুই পর্যটক। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। জানা যায়, তাদের ট্যুর অপারেটর কোনো পূর্ব সতর্কতা দেয়নি, সঙ্গে ছিল না অভিজ্ঞ স্থানীয় গাইডও।
‘বিডি ট্যুর লাভার’ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী নাইমুল বলেন, ‘‘বর্তমানে অনেক ট্যুর গ্রুপ কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৩০/৪০ জনকে নিয়ে ট্যুর দেয়, অথচ এই রকম স্থানে আরও বেশি গাইড বা হোস্ট থাকা উচিত। কিন্তু এরা খরচ কমানোর জন্য সেই নিয়ম মানে না।’’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘স্থানীয় প্রশাসন যখন ৩০/৪০ জনের দলের জন্য মাত্র দুইজন গাইডকে অনুমতি দেয়, তখন প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়া এসব ট্যুরে দড়ি, লাইফ জ্যাকেট, ফার্স্ট এইড, এমনকি সাঁতার জানার বিষয়টিও যাচাই করা হয় না। প্রশাসনের নজরদারি আরও বাড়ানো দরকার।’’
নিয়মিত পাহাড় ভ্রমণকারী সানজানা ইসলাম বলেন, ‘‘ট্যুর অপারেটররা পর্যটকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা জানার প্রয়োজনই মনে করে না। এতে অনভিজ্ঞ পর্যটকদের জন্য পুরো দলের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে। প্রশাসনের কঠোর তদারকি জরুরি।’’
‘খুঁজি বাংলাদেশ ট্রাভেলার্স’-এর হেড অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হাবিব জানান, ‘‘১২ জনের দলের জন্য একজন প্রশিক্ষিত গাইড বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে অনেক অপারেটরদের কোনো সরকারি লাইসেন্স নেই। এমনকি দু-একটি ট্যুর দিয়েই নিজেদের ‘ট্যুর অপারেটর’ দাবি করছে অনেকে। পাহাড়ি দুর্ঘটনার সময় ফার্স্ট এইড, সাপে কাটলে করণীয়—এদের কিছুই জানা নেই। এতে ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়াও যারা গাইড আছেন তাঁদের যোগ্যতাও কি গাইড হওয়ার মত কিনা এ বিষয়টাও কেউ দেখছে না।’’
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর (নিবন্ধন ও পরিচালন) বিধিমালা ২০২৪ অনুসারে, লাইসেন্সবিহীন ট্যুর পরিচালনা, মিথ্যা তথ্য প্রচার ও নিরাপত্তা অবহেলা—সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে বাস্তবে এসব মানা হচ্ছে না।
ফলাফল—প্রাণহানি, দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যু। পরিবারের কান্না, বন্ধুদের হাহাকার।
এছাড়া সাধারণ পর্যটকদেরও সচেতন হতে হবে। ইউটিউব ভিডিও বা ফেসবুক বিজ্ঞাপন দেখে নয়—যাচাই করে, খোঁজ নিয়ে ট্যুর বুক করতে হবে। সস্তার লোভে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বোকামি।
পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করুন, তবে সচেতন থাকুন। নয়তো সেই পাহাড়ই হয়ে উঠতে পারে জীবনের শেষ দৃশ্য।