কক্সবাজারের হিমছড়ির প্যাঁচারদ্বীপ এলাকায় কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী প্রতিকূল আবহাওয়ায় সাগরে নামেন। স্থানীয় জেলেদের বারণ উপেক্ষা করেন তারা। বৃষ্টি শুরু হলে দুই বন্ধু সৈকতে উঠে আসতে পারলেও বাকি তিনজন ভেসে যান। দুইজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও আরেক শিক্ষার্থীকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ থাকা, সমুদ্রনগরী কক্সবাজারে রেললাইন যুক্ত হওয়া এবং নতুন নতুন ঝর্না-ঝরাসহ দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় আগের চেয়ে পাহাড় ও সমুদ্রে পর্যটকদের আনোগোনা বেড়েছে। একই সঙ্গে এসব স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব, পর্যটকদের অসচেতনতা ও হেঁয়ালিপনায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আনন্দের ভ্রমণে পড়ছে শোকের ছায়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ে হাইকিংয়ে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না নেওয়া, প্রতিকূল আবহাওয়া থাকার পরও অতি উৎসাহীদের পাহাড়ে যাওয়া, ভ্রমণ নিয়ে সচেতনতার অভাব, ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভুল পরামর্শ পাহাড়ে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর সমুদ্রের ক্ষেত্রে পর্যটকদের অসচেতনতা এবং সৈকতগুলোতে পর্যাপ্ত লাইফগার্ডের অভাব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।
দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর সি সেফ প্রজেক্টের মাধ্যমে কক্সবাজারে তিনটি সৈকতে ২৭ জন প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী পর্যটকদের সেবা দিয়ে আসছেন। ২০১৫ থেকে চলতি বছরের ৭ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজার সৈকতে দুর্ঘটনায় মারা যান ৬৩ জন। এ সময়ে সি সেফের লাইফগার্ড কর্মীরা ৭৯৫ জন পর্যটককে বাঁচান। গত বছর রেকর্ড ১৪৩ জনকে তারা উদ্ধার করেন। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ১১ জন পর্যটক সৈকতে প্রাণ হারান। এ সময়ে ৫৩ জনকে উদ্ধার করা হয়। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, বেসরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এই উদ্যোগের মেয়াদ আগামী সেপ্টেম্বরে শেষ করার কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক অনুপাতে নেই লাইফগার্ড কর্মী। সমুদ্র পর্যটন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকলেও সৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। লাখ লাখ পর্যটককে সৈকতের পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ার থেকে লাইফগার্ডরা পর্যবেক্ষণ করেন। আর নয়টি স্কি টিউব ও একটি মাত্র রেসকিউ বোট দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের অধীনে অস্থায়ী ভিত্তিতে কক্সবাজারে মাত্র ২৯ জন বিচ কর্মী আছেন। তারা লাল-হলুদ পতাকা উড়ানো, পর্যটকদের সতর্ক করতে মাইকিং করেন।
সিআইপিআরবি-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. একেএম ফজলুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকরা সাগরে নেমেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সংখ্যায় সীমিত হলেও আমাদের লাইফগার্ডরা যথেষ্ট চেষ্টা করেন পর্যটকদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। কিন্তু পর্যটকরা বারণ শুনতে চান না। সৈকতে আরও সচেতনতা ও লাইফগার্ডের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। লাখ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হাতেগোনা লাইফগার্ড দিয়ে সম্ভব না। কক্সবাজারে আরও বেশি ওয়াচ টাওয়ার বাড়ানোসহ ইনানী ও অন্য সৈকতগুলোতেও লাইফগার্ডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের প্রকল্পের অর্থায়ন আছে। এটি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।
গত ৯ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ‘মেলখুম ট্রেইল’ ঘুরতে এসে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়। এ সময় আরও তিনজন আহত হন। উপজেলার সোনাপাহাড় এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১৫ জুন চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার সীমান্তবর্তী রূপসী ঝরনার কূপে ডুবে এক পর্যটক মারা যান। এর আগে ১৪ জুন সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা ঝর্নায় পা পিছলে মারা যান আরেক পর্যটক। জানা যায়, শুধু এই দুই উপজেলার ঝর্নাগুলোতে গত ৫ বছরে ২২ পর্যটকের মৃত্যু হয়। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
গত ৮ জুন ক্রিসতং-রুংরার সামিট ট্যুরে অংশ নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রস্তুতি ছাড়াই তিন পর্যটক পাহাড়ি ঢলে নেমে প্রবল পানির স্রোতে ভেসে যান। এতে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও আরেকজন নিখোঁজ আছেন।
পর্বতারোহী, ট্রেকার ও ভ্রমণ উদ্যোক্তা তৌফিক আহমেদ তমাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অভিজ্ঞ ভ্রমণ গাইড ছাড়া যে পর্যটকরা শুধু বন্ধুবান্ধব মিলে পাহাড়ে ভ্রমণে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। অসাবধানতাবশত তাদের অনেকেই ঝর্না ও পিচ্ছিল ট্রেইলে কীভাবে হাঁটতে হয় তা অনুসরণ করেন না। ঝুঁকি না নিয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো তাদের এড়িয়ে চলা উচিত। পাহাড়ে নির্দিষ্ট কিছু স্থানেই দুর্ঘটনা বেশি হয়। যেমন-নাপিত্তাছড়ায় প্রতিবছরই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, মিরসরাই ও সিতাকুণ্ডের রেঞ্জগুলো মানুষ বনবিভাগ ও জেলা প্রসাশনের কাছ থেকে লিজ নিয়েছে। সেখানে এখন টিকিট দিয়ে পর্যটকদের যেতে হচ্ছে কিন্তু যারা এই লিজ নিয়েছেন টিকিটের মূল্যের বিপরীতে কোনো সেবাই দিচ্ছেন না। নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখছে না। সেখানে বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের কোনো প্রতিনিধিও নেই। সরকার যাদের কাছে এসব স্থান লিজ দিয়েছে, নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ