আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে ভোট হবে কি না-জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘পিআর তো আরপিওতে নেই। আইন না বদলালে তো আমি এটা করতে পারি না।’ সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান বিতর্কের মধ্যে গতকাল নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জোর প্রস্তুতি চলছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। এ ব্যাপারে সিইসি বলেন, ‘ভোটের দিনের দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে।’ গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কানাডার অভিজ্ঞতা, ‘শাপলা’ নিয়ে কাড়াকাড়ি, জাতীয় পার্টিকে সংলাপের আমন্ত্রণ, পিআর পদ্ধতি, পোস্টাল ভোট, নতুন দল নিবন্ধন, নির্বাচনি পরিবেশ, ইসির ভোট প্রস্তুতিসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেন সিইসি।
সিইসি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যমান সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী ভোট করার অপেক্ষায় রয়েছে কমিশন। একজন সম্পাদকের লেখা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘সব খেলোয়াড় যদি ফাউল করার জন্য মাঠে নামে, ম্যাচ পণ্ড হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সবাই ফাউল করার জন্য মাঠে নামলে তো মুশকিল। কেউ যেন ফাউল না করে, সে বিষয়ে আমরা তৎপর। নির্বাচনে কেউ ফাউল করতে নামবে না, ভালো নিয়তে নামবে আশা করি।’ ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ সালের ভোটের আগেও ‘গোলমাল’ হয়েছিল মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার জন্যই চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। এজন্য যা যা করা দরকার জোরেশোরে নিচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টাও নিউইয়র্কে যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। আমরা এ ঐতিহাসিক নির্বাচনের জন্য কাজ করছি।’ এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চেয়ে সিইসি বলেন, ‘আমরা কারও কথায় চলছি না। আইনকানুন, সংবিধান অনুযায়ী সরল-সোজা পথে চলতে চাই। বাঁকা পথে বা কারও ফেভারের জন্য কাজ করছি না। রাজনৈতিক দল আমাদের মূল স্টেকহোল্ডার। উনাদের সহযোগিতা ছাড়া সুন্দর নির্বাচন সম্ভব নয়।’ আগামী নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে ইসির পক্ষ থেকে ‘সর্বশক্তি প্রয়োগ করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রত্যাশার কথাও তিনি বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ বলেনি যে ইলেকশনে ফাউল করার জন্য নামবেন। আশা করি সবাই সহযোগিতা করবেন। সরকার দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ঐকমত্য কমিশন তো সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন দলের চার-পাঁচ জন নিউইয়র্কেও গেছেন। সেখানেও আলোচনা হবে আশা করি। রাজনীতিবিদদের ওপর আমার আস্থা রয়েছে।’
অতীতের কথা মনে করিয়ে দিয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘১৯৯১ সালে অনেক গোলমাল হয়েছে। পরে সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। ’৯৬-এএর ইলেকশনের আগেও গোলমাল হয়ে পরে সব ঠান্ডা। ২০০৮ সালেও এ রকম গোলমাল হয়েছে। সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। নানান মত থাকবে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে সবাই এক জায়গায় আসবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি জানান, ‘ভোটের মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী থাকবে। ইসিও সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবে। কোনো রাজনীতিবিদ ফাউল খেলার জন্য নির্বাচনের মাঠে নামবেন বলেননি। উনারা চাচ্ছেন সুন্দরভাবে খেলবেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চাচ্ছেন। আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করব। ১ লাখ আর্মি সদস্য নামবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমি খুব কনফিডেন্ট; কোনো ভয় পাওয়ার কারণ নেই।’ নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কবে হবে-জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘দলগুলো নিয়ে আমাদের কিছু অ্যাডিশনাল ইনফরমেশন কালেক্ট করতে হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার নিয়ত করে আমাকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরে কোনো অভিযোগ যদি আসে সেগুলো আবার অ্যাড্রেস করতে হবে।’
নতুন কোন দল নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে ও কয়টি, সে সংখ্যা চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, ‘এখন বলা যাচ্ছে না কারণ আমরা আরও অ্যাডিশনাল ইনফরমেশন আমাদের কালেক্ট করতে হচ্ছে। এগুলো যখন চূড়ান্ত হবে তখন হয়তো বলা যাবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শাপলা প্রতীক পাচ্ছে কি না-জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এর আগে মাহমুদুর রহমান মান্নার দল নাগরিক ঐক্য শাপলা প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছিল। তখন কোনো আলোচনা ছিল না। এখন কেন এত আলোচনা বুঝলাম না।’
নির্বাচনি বিধি সংশোধন করে এনসিপির জন্য শাপলা প্রতীক চেয়ে গতকালের চিঠি দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এটা আমাদের কমিশনে আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা কমিশন সভায় বসে আলোচনা করে যা করার করব।’ এনসিপি শাপলা পাচ্ছে কি না-জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এটাও কমিশনের সিদ্ধান্ত। সব সিদ্ধান্তের যদি আমরা কারণ ব্যাখ্যা করতে চাই, তাহলে তো কাজ করা মুশকিল।’
ইসি সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসবে কি না এবং জাতীয় পার্টি সংলাপে থাকবে কি না-জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘সেটা সময় আসুক। আমরা শুরু তো করি নাই। রাজনৈতিক দলের সাথে একটু পরে বসব আমরা। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন সিভিল সোসাইটি, ওমেন রিপ্রেজেন্টেটিভ, একাডেমিশিয়ানস, মিডিয়া পারসোনালিটিসদের সঙ্গে আগে আমরা বসব। শেষের দিকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা সংলাপে যাব।’
প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে কানাডা সফর শেষে ১৮ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন সিইসি। এ প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘কানাডা গিয়ে দেখলাম প্রবাসীদের বোঝার ও জানার মধ্যে অনেক গ্যাপ আছে। প্রবাসী ভোটের সিস্টেমটা মাত্র শুরু করলাম। ইসির প্রতি যে আস্থা সেটা আগে রিস্টোর করা দরকার। আইটি সাপোর্টে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোট নেওয়া হবে।’ জাতীয় পার্টি সংলাপে আসতে পারবে কি না-এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির পাঁচটি প্রস্তাব পেয়েছি। আপনারা কয়টি পেয়েছেন জানি না, কোন জাতীয় পার্টির কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। লাঙ্গলের দাবিদার তো একাধিক।’ লাঙ্গল প্রতীক কাকে দেবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘লাঙ্গলের দাবিদার একাধিক। সময় আসুক তখন আপনারা দেখবেন।’