সম্প্রতি যুক্তরাজ্যসহ ছয়টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে। কানাডাও স্বীকৃতি দিয়েছে। কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর এই রিকগনিশনের পরও ইসরায়েলকে খুব সহজে সোজা পথে আনা যাবে কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত সাম্প্রতিক প্রস্তাব, প্রভাবশালী দেশগুলোর স্বীকৃতি ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানে তেলআবিব বিচলিত নয়, যদিও নেতানিয়াহু হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এই হতাশা হিংসাত্মক। কার্যত ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। পক্ষান্তরে হামাস বিজয়-উল্লাস করছে, যেন বা এই স্বীকৃতি তাদেরই অর্জন। আসলে ১২ সেপ্টেম্বর গৃহীত জাতিসংঘের প্রস্তাবে মাহমুদ আব্বাসের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং হামাসের প্রতি অস্ত্র সংবরণ ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিজেও হামাসের প্রতি অনুরূপ আহ্বান জানিয়েছেন। সেই আহ্বানে গাজার এই সশস্ত্র দলটি কর্ণপাত করছে না। তারা এমন একটা ধারণা তৈরি করতে চাইছে, যাতে গাজায় নিপীড়িত জনগোষ্ঠী মনে করে যে হামাস এই স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। এরূপ ধারণা তৈরি করা গেলে পশ্চিমতীরে আপন দেশে পরবাসী এবং নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত মানুষেরও অনেকে বিভ্রান্ত হতে পারে। এটা হচ্ছে ক্যামোফ্লাজ। প্রতিপক্ষের চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল।
হামাসের প্রতিপক্ষ কে? ইসরায়েল নাকি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ? নাকি এই দলটি যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ তৈরি করতে চায়? ফিলিস্তিন প্রশ্নে ওয়াশিংটনেরই বা কী প্ল্যান? অতীতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল; দ্বি-মেরু বিশ্বে ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাববলয় বিস্তারের যে ধরনের কৌশল করেছে, নতুন পরিস্থিতিতে তারা আরও বেশি খোলামেলা হতে শুরু করেছে। এক মেরু বিশ্বের মোড়ল এই দেশটির এখনকার পরিকল্পনা ভূমধ্যসাগর তীরের ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের সংকীর্ণ এলাকাটিকে বিচ্ছিন্ন করে অবকাশ কেন্দ্র তৈরি করা, যার কর্তৃত্ব থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এই পরিকল্পনার নাম গ্রেট ট্রাস্ট। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন, গাজা অঞ্চলটি হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা। ইতালিয়ান রিভিয়েরা শব্দটির অর্থ অবকাশ কেন্দ্র। কালক্রমে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায়ও শব্দটির প্রচলন হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যাখ্যা করে বলেন, সমুদ্রপাড়ের এই এলাকায় গড়ে উঠতে পারে বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট। এজন্য এখানকার জনবসতি সরিয়ে দিতে হবে। কীভাবে সরানো হবে। সে পরিকল্পনাও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ করেন। জনবসতি সরিয়ে পড়শি দেশসমূহে ভাগাভাগি করে দেওয়া যাবে। এই অঞ্চলের মালিকানা পেলে যুক্তরাষ্ট্র এখানে নির্মাণকাজ করবে। ধ্বংসস্তূপ ও অবিস্ফোরিত বোমা অপসারণ করে নির্মাণ করা হবে, হয়তো হোটেল-মোটেল, সুন্দর রাস্তাঘাট, শপিং মল ইত্যাদি। মোট কথা পর্যটক আকর্ষণের জন্য যা যা করা দরকার- সবই করা হবে। এ ধরনের একটি পরিকল্পনা প্রকাশের পর যাতে প্রতিবাদের ঝড় না ওঠে, তার জন্য তিনি নিজেই এটাকে হালকা করে দেন এই বলে, না! না! এটা একটা প্রস্তাবমাত্র! সিরিয়াস কিছু না। মনে হয় তিনি হাসতে হাসতেই কথা কটি বলেছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা কতটা হালকা বা ভারী তা চট করে বলে দেওয়া কঠিন। তবে দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকার প্রেসিডেন্টের হাস্যরসাত্মক কথাও হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। ভূরাজনৈতিক বাতাসে কথাটি তিনি জাস্ট ছেড়ে দিলেন, সময়মতো থিতু হবে; হয়তো সেই আশায়। গ্রেট ট্রাস্ট তত্ত্বটি যে যথেষ্ট ওজনদার তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিউইয়র্কে ফিলিস্তিন প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বর্জন ও ভোটাভুটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূরে থাকার মধ্য দিয়ে। স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রায় সব দেশ ম্যান্ডেট দিলেও ইসরায়েল ও আমেরিকা এটা মেনে নেয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে হামাসকে পুরস্কৃত করা হলো। অথচ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়ে হামাস প্রাসঙ্গিক নয়। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় হামাস কোনো পক্ষ নয়, এটি মূল ভূখণ্ড থেকে শত কিলোমিটার দূরের একটি বিচ্ছিন্ন গাজা স্ট্রিপে সক্রিয় সশস্ত্র উপদল মাত্র, যারা সেই সংকীর্ণ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ ও শত্রুতার ছলে হামাসকে স্বীকৃত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখাবার চেষ্টা করছে।
গাজায় আজ যে ভয়াবহ গণহত্যা চলেছে, যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা কোনো স্থানীয় আঞ্চলিক সমস্যা নয়। এই সমস্যা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের তো বটেই গোটা মধ্যপ্রাচ্যের। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য হামাস নিজেই তো একটা বড় সমস্যা! ইসরায়েল হচ্ছে বিষফোড়া আর হামাস হচ্ছে নকল গোপাল ঘি! কমিউনিস্ট তত্ত্বে রেড ফ্ল্যাগ অপোজ টু রেডফ্ল্যাগ বলে একটা কথা আছে। লাল পতাকা কমিউনিস্ট বিপ্লবের প্রতীক। কমিউনিস্টদের অগ্রযাত্রা রুখতে বিরুদ্ধবাদী গোষ্ঠীও লাল নিশান উড়িয়ে মিত্রের ভূমিকায় নেমে এমন সব কাজ করতে পারে, যাতে শত্রুর পক্ষে আঘাত হানা সহজ হয়। রণাঙ্গনে এরা ফিফথ কলাম হিসেবেও পরিচিত। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত চলা স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় এই শব্দবন্ধের বহুল ব্যবহার হতে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ইউরোপের বিভিন্ন রণাঙ্গনে এদের তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। এরা দেশের ভিতরে থেকে এমন সব দল বা উপদল গড়ে তুলেছিল যাদের কাজ ছিল মিত্রশক্তির বেশে গোলযোগ লাগিয়ে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে শত্রুর স্বার্থ রক্ষা করা। বাংলায় এদের বলা হয় পঞ্চম বাহিনী।
ফিলিস্তিনের বিচারে হামাসকে সরাসরি পঞ্চম বাহিনী বলা হয়তো যাবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই সশস্ত্র গ্রুপটির কার্যকলাপ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা। এরা গাজায় উপর্যুপরি ইসরায়েলি হামলা ও দখলদারির পারিপার্শ্বিক যুক্তির জায়গা তৈরি করে চলেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত রকেট হামলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তখন পরিস্থিতি অনেক শান্ত হয়ে এসেছিল। সেই হামলার মাধ্যমে আসলে জায়নিস্ট প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে উসকে দেওয়া হয়েছিল, যাকে বলে আগুনে ঘৃতাহুতি। আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া যাতে ভালো করে জ্বলতে পারে। যখন উল্টো ইসরায়েলি আক্রমণ শুরু হলো তখন হামাস চুপ। কোথায় গেল তার অস্ত্রের মজুত! কোথায় গেল তার দুঃসাহসী যোদ্ধারা, কোথায় হামাসের প্রতিরোধ! যারা রকেট নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের আয়রনডোম গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলকে নাস্তানাবুদ করে দিতে পারল। তারা নাগরিকদের রক্ষা করতে গাজায় কোনো প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলতে পারল না কেন? হামাসের পক্ষে অজুহাত অনেক দেওয়া যাবে। কিন্তু ধোপে টিকবে না। গত জুনে ১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়ও হামাস কেবল লিপ সার্ভিসই দিয়ে গেছে। হুতি বিদ্রোহীরা ইরানের সমর্থনে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। কিন্তু হামাস সে পথে যায়নি। যদি হামাসও ইরানের পাশাপাশি ইসরায়েলে আক্রমণ চালাত তাহলে ইসরায়েলের পক্ষে ১২ দিনও টিকে থাকা সম্ভব হতো না। গাজা প্রশ্নেও ইসরায়েলকে নমনীয় হতে হতো। এই পটভূমিতে হামাসের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ফিলিস্তিনে মাহমুদ আব্বাসের বৈধ কর্তৃপক্ষকে হামাসের মেনে না নেওয়ার উদ্দেশ্য একটি সংকীর্ণ ও বিপর্যস্ত এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফিলিস্তিন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলা বলেই মনে করেন অনেকে। এতে স্পষ্টতই ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা সহজ হয়েছে।
প্রসঙ্গত ভূমধ্যসাগর তীরের গাজা অঞ্চল থেকে বর্তমান ফিলিস্তিনের মূল ভূখণ্ড পশ্চিমতীরের দূরত্ব এক শ কিলোমিটারের কাছাকাছি। মাঝখানে পশ্চিম ও দক্ষিণে ইসরায়েল। যাতায়াতের জন্য কোনো নিরাপদ করিডর নেই। ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের ক্রসিং পাস নিয়ে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরায় যাতায়াত করতে হয়। এমতাবস্থায় ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য যেখানে প্রয়োজন সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য সেখানে তৈরি করা হয়েছে দূরাতিক্রম্য রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। তাহলে কি গাজা হামাসের পরোক্ষ সহযোগিতায় আমেরিকার হাতে চলে যাবে? ইসরায়েল কি সেজন্যই গাজায় চালিয়ে যাচ্ছে নরমেধযজ্ঞ?
ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের স্বীকৃতির পর যে অবস্থান গ্রহণ করেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ভূমিকার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির ভিত্তিতে আরব শার্দূল ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে গঠিত হয় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। এটি ছিল ঐতিহাসিক অর্জন। এই অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু ইসরায়েলের লিকুদ পার্টি ও কট্টর জায়নবাদী গোষ্ঠী অসলো চুক্তি মেনে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত আইজাক রবিনকে জীবন দিতে হয় আততায়ীর ছুরিকাঘাতে। ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিল; কারণ ১৯৮৮ সালে পিএলওপ্রধান ইয়াসির আরাফাত আলজিয়ার্সে ফিলিস্তিন সম্মেলনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখনই ওআইসির সদস্যভুক্ত বেশির ভাগ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। তখন বলা হয়েছিল, ধাপে ধাপে স্বাধীন ফিলিস্তিন কার্যকর হবে। ২০০২ সালে জর্জ ওয়াকার বুশ মধ্যপ্রাচ্য শান্তির রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। তিনি দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ওপর জোর দেন। প্রসঙ্গত ১৯৩৭ সালে গঠিত পিল কমিশন সর্বপ্রথম দ্বিরাষ্ট্র পরিকল্পনা প্রকাশ করে। ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে বিরোধপূর্ণ এলাকায় দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। আমেরিকা পূর্বাপর এই প্রস্তাবের সমর্থক হয়েও এখন বেঁকে বসল। কিন্তু কেন?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক