পোস্তগোলার হাজি শরিফ উদ্দিনের বাসায় ডাকাতি করতে এসে ডাকাত দল চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন রেখেছে ঘরে বারান্দায় রাস্তায় সিসি ক্যামেরা থাকার কী দরকার। সিসি ক্যামেরা থাকায় তাদের বেশ বেগ পেতে হয় দায়িত্বকর্তব্যকর্ম পরিপালনে। ইদানীং কেউ কেন বুঝতে পারছে না বা চাচ্ছে না যে ট্রাফিক সিগন্যাল ডিজিটাল হলে ট্রাফিক জ্যামে ফুয়েল খরচ কমে যাবে, সময় বাঁচবে যাত্রীদের, তা সত্ত্বেও ট্রাফিক পুলিশের কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার ব্যাপারটি বড় বিবেচনায় এসে গেল। কেন বুঝে আসে না অটোমেশন হলে যে বা যাদের দেখাসাক্ষাৎ, মুলামুলি, কোলাকুলি কমে যাবে, সেই উভয় পক্ষই চায় তাদের স্বার্থে বিলম্ব ঘটুক অটোমেশনে। চৌকিদার-দফাদারদের কার্যপরিধি পরিবর্তনের দাবি করেছে চোর ডাকাতদের কেন্দ্রীয় সংগঠন চোডাস (চোর ডাকাত সংঘ)। তাদের যুক্তিও চমৎকার, চোর ডাকাতদের আদি পেশা পরিপালনে চৌকিদার-দফাদাররা খামোখা ধরাধরিতে না গিয়ে বরং একটু সাহায্য-সহযোগিতা করতেই তো পারে। এতে লাভ উভয় পক্ষের। যেমন মালসামান নিয়ে চোর পালানোর সময় তাকে বাধা না দিয়ে চৌকিদার চাচ্চু অভয় দিয়ে একটু এগিয়ে দিয়ে এলে ক্ষতি কী। ক্ষতি কী চোর ডাকাতের জ্বালায় অতিষ্ঠ গ্রামবাসীর হাত থেকে চোর ডাকাতদের একটু আধটু আড়াল করা। ভুপেনবাবুর প্যারোডি হতে পারে- ‘চোর চোরের জন্য ডাকাত ডাকাতের জন্য, চৌকিদারের একটু সহানুভূতি কি চোরেরা পেতে পারে না, ও বন্ধু।’ ঔপনিবেশিক আমলের কবি রবিঠাকুর ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’ কথাটা ঠিক বলেছিলেন কি না, স্বাধীন দেশের চৌকিদার-দফাদাররা তা মনে করতে পারে না, কেননা তারা যে ক্লাসে রবিঠাকুর পড়ানো হতো তাদের সেখানে প্রবেশ ঘটেনি, কিংবা অটোপাস বা শর্ট সিলেবাসে সে বিদ্যের পানি তাদের ঘটে পড়েনি।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশ ভারতের লর্ড মেয়ো চৌকিদার পদপ্রথা প্রবর্তনকালে চৌকিদারদের যে মর্যাদা ও দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ১৫৫ বছর পর স্বজাতির স্বার্থে চোর ডাকাতদের সঙ্গে তাদের দহরম মহরমে কম যায় না, এখন ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ শব্দ বিপর্যয়ের বদৌলতে বিপরীত (দুষ্টের পালন শিষ্টের দমন) বলয়ে চলে গেছে। যাবেই বা না কেন, চৌকিদাররা তো তাদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণকর্তার সঙ্গে নিমকহারামি করতে পারে না। চৌকিদার-দফাদাররা স্বাভাবিকভাবে এখন চোর ডাকাতদের প্রতি ‘মানবিক আচরণ’-এর পথ ধরেছে, রীতি ও বিধিমতো একচোখা হয়ে তাদের ‘মৌলিক অধিকার’ রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত। আমানতকারীদের টাকা লুট হতে দিয়ে এখন লুটকারীরা লুটের টাকায় আইনের আশ্রয় (যাতে লুট করা টাকা ফেরত দিতে না হয়) প্রশ্রয় ক্রয় করছে। চৌকিদার-দফাদার টাকা উদ্ধারের পরিবর্তে এখন প্রচুর পথ পন্থার প্যাঁচে পস্তাচ্ছে। গৌরীপুরের সাধারণ আমানতকারী সাধন সরকারকে ব্যাংকে তার জমানো টাকা ফেরত পাওয়ার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে খেসারত দিতেই হচ্ছে। নরিম মাঝি, সফুরা খাতুনদের কথা কেউ রাখেনি।
গত শতকে চোর ডাকাত সংঘের একটি প্রকল্প প্রসঙ্গে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর এক লেখায় পাওয়া যায়- গ্রামের চোরেরা বাড়িতে বাড়িতে গভীর অন্ধকারে কাজ সারত। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল ধনবান এক বাড়িতে কিছুক্ষণ পর পর আলো জ্বলে ওঠে। ফলে চোরদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বেশ অসুবিধার সৃষ্টি হয়। তখন চোরদের সমিতি তত্ত্বতালাশ শুরু করল ওই বাড়িতে কেন ঘন ঘন আলো জ্বলে ওঠে। জানা গেল ওই বাড়িতে একজন বহুমূত্র রোগীকে রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব করতে উঠতে হয় এবং সেজন্য আলো জ্বালানো হয়। চোরদের চিন্তা চৌবাচ্চা (থিংক ট্যাংক) পর্যালোচনা করে সুপারিশ করল ওই ব্যক্তির ডায়াবেটিসের চিকিৎসা না হলে রাতে বারবার বাতি জ্বালানো কমবে না। তখন চোরদের নেতা নির্দেশ দিলেন ওই রোগীকে ডায়াবেটিক সমিতির হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। ডায়াবেটিস চিকিৎসাকে জনসচেতনতায় আনতে ইবরাহীম খাঁ এ রস রচনা লিখেছিলেন। এই শতকে এসে এখন দেখা যায় গোটা সমাজ দুর্নীতির ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যারা যত দুর্নীতি দমনের বিচার-আচারের উদ্যোগ নেবে চোর ডাকাত সংঘের কাছে তা বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার শামিল হবে। দুর্নীর্তিকে ওয়াকওভার দেওয়ার উপায় হিসেবে চৌকিদার-দফাদারকে কীভাবে নিষ্ক্রিয় করা যায়, কীভাবে তাদের ক্ষমতাহীন করা যায় সে চেষ্টা চলাটাও অস্বাভাবিক নয়। এটাও অস্বাভাবিক নয় যে চোর ডাকাতরা ভারী উৎকোচ দিয়ে চৌকিদার-দফাদারদের নিজেদের দলে ভেড়ানোর পথ-পন্থা অবলম্বনে কসুর করবে না। তা না হলে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়া দাগি আসামি সীমান্ত পার হওয়ার পাঁচ মিনিট বিলম্বে তার ‘দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা’ সীমান্ত প্রহরীর কাছে পৌঁছানো হতো না। নইকাটির সিঁধেল চোর নুকে মাজন যখন পাড়াপ্রতিবেশীর ভয়ানক চোট ও চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছিল তখন তাকে তল্পিতল্পাসহ পালিয়ে যেতে রমেন দফাদার গংরা কী সুন্দর প্রক্রিয়ায় না সাহায্য করল। পাড়াপ্রতিবেশীরা হতভম্ব! ভারতে ব্রিটিশ সরকার যখন দেখল এদেশীয় চোরবাটপারদের দমন দেশীয় চৌকিদার-দফাদারদের দ্বারা সহজ না, এরা এমন এক সম্প্রদায় বিদ্যমান আইনকানুনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উপায়ও সহজ না। অতত্রব তারা শেষমেশ এ মহাজন উপদেশ বাক্য বিতরণ করে প্রশান্তি পেতে চাইল যে- ‘চোর তো চুরি করবেই কিন্তু গৃহস্থকে সাবধান থাকতে হবে।’ চোরকে চুরি করার অধিকার দিয়ে তাদের দমনের পথ-পন্থা না বাতলিয়ে গৃহস্থকে সজাগ থাকতে বলেই তারা খালাস। ভাবখানা এই ওরা মরুক। ব্রিটিশের হেঁয়ালিপূর্ণ এই বাণী শুনে ভারতবাসী হালে বাংলাদেশিদের বলার কিছু ছিল না বা নেই জাতীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রয়াস চলছে, চলবেই। ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’, সেই জনতার মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করে প্রকৃত প্রস্তাবে চৌকিদার-দফাদারদের সুনাম-বদনাম সর্বজনীন করার সুযোগ তৈরি হয়েই চলছে। যার জন্য একদিকে বলা হচ্ছে বন্ধুর আঁতে ঘা লাগে এমন কিছু করা যাবে না, যা শোভনীয় নয়, নয় সমমর্যাদার সদাচারপন্থি; কিন্তু সেই বন্ধু যখন বিরূপ আচরণ করেই চলে তখন তার কাছে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্রয় লাভও ঘটে। এমতাবস্থায় চৌকিদার-দফাদারদের করার কিছু থাকে না। সামান্য বেতন হলে অঢেল আনুকূল্যপ্রত্যাশী চৌকিদার-দফাদাররা কী আর করবে। বাড়ির আঙিনা দিয়ে বধূ পরের ঘরে গেলেও চৌকিদার-দফাদার তো দূরের কথা, গাঁওগেরামের যে বা যারা কথা বলবে তাদেরও যে হাত করা আছে।
সাম্প্রতিক একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাজধানীর পাশের শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ‘খুবই খারাপ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- (জিপিএ ফাইভ পাওয়া) এ শহরে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি বেড়েছে। দিনের বেলায় এসব ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা মাদক কারবারি ও ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা আদায় করেন। জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ কবিতার প্যারোডি করে বলা যায়- ‘হায় জীবন! জটিল থেকে জটিলেশ্বরের সুর সাধা শেষ হবে কবে।’ রাত পোহাবার আর কত দেরি, পাঞ্জেরী? বেচারা চৌকিদার-দফাদারদের দোষ বা প্রশংসা করে লাভ কী? তাদের যারা পেটে বিদ্যার জ্ঞান ঢোকাবে, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞানের বটিকা সেবন করাত সেই পণ্ডিত মশাইয়েরই তো মগজ ধোলাই করা। তাদের সবতে ডায়াবেটিক সমিতির দরগায় শিরনি খাওয়ানো দরকার। যে খাওয়াবে সে-ও তো নীতিনৈতিকতার দারুণ অপুষ্টিতে ভুগছে। চৌকিদার-দফাদাররা গৃহস্থকে সজাগ করার কাজে সহায়তা করায় মন না দিয়ে চোর ডাকাতদের সহযোগী সাজাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করছে। কেননা চোর ডাকাতরাই নিরীহ গেরস্থের চেয়ে শক্তিশালী, সম্পদশালী। এর থেকে চৌকিদার-দফাদারদের এনাম দিতে তাদের অসুবিধার চেয়ে সুবিধা প্রাপ্তির সুযোগ বেশি। আর নিরীহ নিঃস্ব গৃহীরা না পারছে চৌকিদার-দফাদারদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারছে চোর-ডাকাতদের মোকাবিলা করতে।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান