ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়- এটি দেশের মনন ও প্রজ্ঞার উৎসস্থল। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এটি কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং জাতির চেতনার উন্মেষভূমি, মুক্তচিন্তার আস্তানা এবং সংগ্রামের শানিত বাতিঘর। ১৯২১ সালের প্রভাত থেকে শুরু হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয় আজও দাঁড়িয়ে আছে জাতির আস্থার মূল কেন্দ্রে যেখান থেকে গড়ে উঠেছেন শিক্ষক, কবি, গবেষক, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়ক ও কূটনীতিক; যাঁরা আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখিয়েছেন দেশ ও জাতিকে।
ঐতিহ্যের ধারায় ডুয়ার জন্ম
এ মহিমান্বিত উত্তরাধিকার বহন করেই ১৯৪৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (ডুয়া)। প্রথমদিকে এটি ছিল নিছকই একটি ছোট মিলনমেলা-অতীতের কথা বলা, পুরোনো বন্ধুত্বের উষ্ণতায় কিছুটা সময় কাটানো। কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই ছোট্ট মিলনমেলাই আজ পরিণত হয়েছে এক বিশাল পরিবারের বাঁধনে।
দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা অ্যালামনাইরা এ সংগঠনের মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছেন একই সূত্রে। তাঁদের হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা, আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকার বহনের অঙ্গীকার। ২০২৫ সালে ডুয়া পেরিয়েছে গৌরবময় ৭৭ বছর। এক অনন্য যাত্রা, যা ইতিহাসকে বুকে নিয়ে অগ্রসরমান।
বহুমুখী কর্মকাণ্ড
ডুয়ার কর্মকাণ্ড কেবল স্মৃতি আর পুনর্মিলনের আয়োজনেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একদিকে যেমন প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আবেগের সেতু, তেমনি অন্যদিকে জাতীয় জীবনে একটি কার্যকর শক্তি।
* শিক্ষা সহায়তা : আর্থিক সংকটে থাকা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, বিশেষত শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থীদের শতভাগ বৃত্তি নিশ্চিতকরণ।
* মানবিক উদ্যোগ : দুর্যোগকালে ত্রাণ ও আবাসন সহায়তা, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মসূচি।
* স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি : পথশিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন।
* অবকাঠামো উন্নয়ন : বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলগুলোতে বিশুদ্ধ পানীয় সরবরাহ, বিশেষ করে মেয়েদের হলে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ বাস্তবায়ন।
এসব পদক্ষেপ যেন প্রমাণ করে ডুয়া কেবল স্মৃতির আসর নয়, বরং জাতির দায়বদ্ধতা বহনের এক পরিণত প্রতীক।
বৈশ্বিক বিস্তার আজ ডুয়ার আলো শুধু ঢাকার টিলার গাছপালার ভিতর সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছড়িয়ে গেছে লন্ডনের বৃষ্টিভেজা পথে, নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী অট্টালিকায়, টরন্টোর শীতের স্নোফ্লেকে কিংবা সিডনির সমুদ্রতটে। প্রবাসী অ্যালামনাইদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নানা চ্যাপ্টার- যা প্রমাণ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে-যেই থাকুক, তার শিকড় ছিন্ন হয় না, বরং আরও দৃঢ় হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
৭৭ বছর পূর্তি- এটি এক বিশাল মাইলফলক। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবারের উদ্যাপন হচ্ছে সীমিত আকারে। তবে উৎসবের আড়ম্বর কম হলেও এর প্রতীকী উদ্যোগগুলোই আসল বার্তা বহন করছে- ‘আমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমাজের জন্যও দায়বদ্ধ।’
তবু সামনে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো, সামাজিক কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ, প্রবাসী অ্যালামনাইদের কার্যকর সম্পৃক্তকরণ এবং তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা- এসবই আগামী দিনের প্রধান কাজ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেতুবন্ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মানে দেশের ইতিহাস। আর ডুয়া সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দাঁড়ানো এক অন্যন্য প্রতিষ্ঠান- যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঐতিহ্যের আলো, গড়ে তুলছে নতুন পথচলার শক্তি।
শতবর্ষের গৌরব নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্ববিদ্যালয় যেমন জাতির চেতনাকে জাগিয়ে রাখে, তেমনি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সেই চেতনাকে প্রবাসে, প্রজন্মে এবং সমাজে ছড়িয়ে দেয়। এটি যেন এক সেতু- যেখানে মিলিত হয় অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের দায়িত্ব আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
লেখক : সদস্যসচিব, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন-ডুয়া