আধুনিক বিশ্বে ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে নির্বাচনই একমাত্র পদ্ধতি। যে কোনো নির্বাচনে ইসলাম ভোট প্রদানকে তিনভাবে মূল্যায়ন করে। এক. ইসলামের দৃষ্টিতে ভোটার তার মূল্যবান ভোটটি প্রদানকরত ভোটপ্রার্থীকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে সাক্ষী দিচ্ছে। সাক্ষী দিচ্ছে এ প্রার্থী ভোটারের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ, সৎ ও উপযুক্ত ব্যক্তি। আর এ সাক্ষী যদি অবাস্তব বা মিথ্যা হয় তাহলে ইসলামের বিধান হলো মিথ্যা বলা মহাপাপ। ইহ ও পরকাল ধ্বংস করার জন্য মিথ্যা সাক্ষী একটি মারাত্মক গর্হিত কাজ। তাই যে ব্যক্তি কাউকে ভোট দিচ্ছে আর ভোটারের জানামতে অপর কোনো প্রার্থী ওই ব্যক্তি অপেক্ষা ন্যায়পরায়ণতা ও সার্বিক যোগ্যতার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ তাহলে, ভোটার তার ভোটের মাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষী প্রদান করল। এ জন্য তাকে মিথ্যা সাক্ষীর যথাযথ শাস্তি ভোগ করতে হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে সে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে। সত্য সাক্ষী দিয়েছে। অর্জন করেছে অনেক নেকি। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়সংগত সাক্ষী প্রদান কর।’ (সুরা নিসা-১৩৫)। দুই. ভোট প্রদানের আরেকটি অবস্থান হলো সুপারিশ করা। ভোটদাতা প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তার প্রার্থিত আসন প্রদানের জন্য সুপারিশ করেছে। অনুরোধ করেছে ভোটপ্রার্থীকে আসনটি প্রদানের জন্য। এ মর্মে কোরআনে কারিম বলছে, ‘কেউ কোনো ভালো কাজের সুপারিশ করলে এতে তার অংশ থাকবে এবং কেউ কোনো মন্দ কাজের সুপারিশ করলে এতে তার অংশ থাকবে।’ (সুরা নিসা-৮৫)।
তিন. ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব প্রদান করা হয়। জনগণের ভোটে যারা বিজয়ী হয়ে সংসদ পরিচালনা করে তারা জনগণের প্রতিনিধি। যে যার ভোটে বিজয়ী হলো, সে তারই প্রতিনিধি। অতএব ভোটারকে চিন্তা করে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে। কারণ প্রতিনিধির মাধ্যমে ভালোমন্দ যত কর্ম সম্পাদন হবে প্রতিনিধি নিয়োগকারী বা ভোটারের ভাগেও তা আসবে। এ পরিসরে আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো- ভোটের মাধ্যমে শুধু নিজের প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয় না, বরং একটা জাতি ও দেশের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। ওই প্রতিনিধির ওপর গোটা দেশ ও জাতির উপকার-অপকার নিহিত থাকে। একটি ভোটের মাধ্যমে যে ব্যক্তি একজন অযোগ্যকে জাতির মাথায় বসাবে, তার ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব ভোটারকে নিতে হবে। তাকেই একদিন ভোগ করতে হবে এর ফলাফল।
কোরআন হাদিসের নির্দেশনা সম্পর্কে যারা অবহিত আছেন, তাদের অবশ্যই জানা আছে যে সাক্ষ্য প্রদান করা, সুপারিশ করা ও প্রতিনিধিত্বের অথরিটি প্রদান করার গুরুত্ব ইসলামি শরিয়তে অপরিসীম। তাই আজকের প্রহসনমূলক নির্বাচনব্যবস্থা দেশ পরিচালনায় মিথ্যা, জালিয়াতি ও দুর্নীতি প্রতিরোধে, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ে, একটি শান্তিময় সমাজ ও আদর্শ দেশ বিনির্মাণের আন্দোলনে সঠিক স্থানে ভোট প্রদানের শপথ নিতে হবে। সত্য সাক্ষী, যোগ্য ব্যক্তির পক্ষে ভোট দেওয়া ও মহৎ ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্ব প্রদানের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো ধরনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপন বুদ্ধি ও বিবেচনার মাধ্যমে ভেবেচিন্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি ভোটারকেই ভালো ও সৎ ব্যক্তি অথবা অন্তত মন্দের ভালো প্রার্থীকে নির্বাচন করার জন্য সচেতন থাকতে হবে।
সমাজ, দেশ ও জাতির অভিভাবক হবে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। ন্যায়নীতি, উদারতা ও খোদাভীরুতায় হবে আদর্শপূর্ণ। মানুষের মানমর্যাদা ও জানমাল থাকবে তার কাছে পরিপূর্ণ নিরাপদ। তার মধ্যে বিদ্যমান হবে জ্ঞান-প্রজ্ঞা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং জনসেবা ও কল্যাণমুখী মনোভাবের সমন্বয়। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ভোটার প্রার্থীর যোগ্যতা বিবেচনা করে ভোট প্রদানে সক্ষম হতে হবে। ভোট প্রদানের মাধ্যমে আমানত যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না, অথবা ভোটের মাধ্যমে যাকে প্রতিনিধি নির্বাচনের সুপারিশ করছে, যাকে যোগ্য বলে সাক্ষী দিচ্ছে, তা সঠিক হচ্ছে কিনা, তা বোঝার যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে প্রত্যেক ভোটারকে। বর্তমানে বহুল আলোচিত পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থায় ভোটার সরাসরি প্রার্থীকে যাচাই করা বা প্রার্থীকে ভোট প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। ভোট পাবে দল। ভোটের আনুপাতিক হারে দল থেকে আসন বণ্টন করা হবে। দলই নির্ধারণ করবে কাকে আসন প্রদান করা যায়। তাই এ পিআর পদ্ধতিতে প্রকৃত যোগ্যরা বাদ হতে পারে, বাদ হতে পারে আপনার বিবেচিত প্রার্থী। দলীয় স্বার্থে অযোগ্যরা মনোনীত হওয়া স্বাভাবিক। হতে পারে ভোট দেবেন চৌদ্দগ্রাম, এমপি হবে কুড়িগ্রাম। এ পদ্ধতিতে ভোটারের আমানতের হকদারের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা