নিজেরটা আঠারো আনা বোঝে; অন্যেরটা দুই আনাও বুঝতে নারাজ প্রকৃতির মানুষ দেখলে গা রি রি করে ওঠে সিদ্দিকুল হায়াত বারীর। ১৯৮৫/৮৬ তে রাজধানীর মালিবাগে রজব মামার টি-স্টলে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আমরা সমবয়সিরা পরচর্চাবিষয়ক যে সভায় মিলিত হতাম সেই সভার উচ্চরব সদস্য বারী। অতি আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিদের বিষয়ে তাঁর বিস্তর জ্ঞান। ওই জ্ঞান বিতরণে তাঁর মনোযোগটা নিবিড় নয়। রাগের বশবর্তী হয়ে যেসব আত্মকেন্দ্রিকতার বর্ণনা দিতেন, সেগুলো নোটবুকে টুকে রাখলে একটা গ্রন্থ রচনা করা যেত।
কমার্শিয়াল ফার্মের একজিকিউটিভ পদে আসীন সিদ্দিকুল হায়াত বারী এক সন্ধ্যায় টি-স্টলের মালিককে বলেন, ‘রজব মামু! জলদি দুই খান বাটার টোস্ট খাওয়াও। এরপর খুব কড়া লিকারের এক কাপ রং চা দাও। সুগারলেস কিন্তু। দোকানি রজব আলী বলেন, ‘চা বলেন টোস্ট বলেন, বাটার বলেন, যা বলেন, সবই খাওয়ামু। মাগার নগদ টাকায়। কেন এরকুম কইলাম জিগান। আরে! জিগান্না কেলায়?’
‘আগের এক শ আশি টাকা শোধ করিনি, তা-ই।’ বলেন বারী, ‘আজকের তিন টাকার সঙ্গে আগের বাকি এক শ আশিরে প্লাস কর। কত পাওনা হলে তুমি? এক শ তিরাশি টাকা পঞ্চাশ পয়সা। বেতন পাওয়ামাত্র তোমার এই টাকা তোমারে দেব, কোনো সন্দেহ নাই।’
টি-স্টল মালিক রজব আলী বলেন, ‘শুধু আওয়াজ দিলে তো সন্দেহ দূর হয় না মামু। আওয়াজ আর কাজের মধ্যে দোস্তি হওন দরকার। আউজকা হইল গিয়া মাসের সাতাইশ তারিখ। দুইন্নার বেবাক অফিসে তন্খা (বেতন) হইয়া, সাহেবরা খাইয়া দাইয়া হজম কইরা সামনের মাসের ল্যাজ ধইরা ঝুইল্লা পড়নের জোগাড়ে আছে, আর আপনি কইতাছেন আপনার তন্খা হয় নাইক্কা। আপনের কোনো দোষ নাই মামু। দোষ তো আমার। গরিবের পোলা আমি, বিদ্যাবুদ্ধি নাই। যে যেই মেওয়া দেখাবে, সেই মেওয়া দেইখা নাচনের বরাত লইয়া পয়দা হইছি।’
নিজের বৈশিষ্ট্য বিচার করে অন্যকে যাচাই করবার রীতি অবলম্বন করলাম। যতবার বাক্যবাণে চিৎপাত হয়েছি ততবারই বাণ নিক্ষেপকারীকে পিটুনি দিতে চেয়েছি। তাই মনে হচ্ছিল, দৃশ্যত স্তম্ভিত-নির্বাচক বারী মনে মনে রজব আলীকে ইতোমধ্যে বার দশেক আছাড় মেরে ফেলেছেন। তবে মুখে বললেন, ‘দেখ মামু! দুপুর থেকেই মেজাজটা আমার খিঁচড়ে রয়েছে। তারপর তুমি এখন আমাকে মিথ্যুক প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। তুমি কী ভাব নিজেকে! হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মালিক?’
প্রশ্নের উত্তরে রজব আলী যা বললেন তা শুনে স্টলের গোটা দশেক খদ্দেরের সবাই হাসতে লাগলেন। রজব বলেন, ‘জে না। আমার মাথায় তো ছিট নাই। কেন ওরকম ভাবতে যামু? খাড়ান, খাতাটা দেখি...।’ বাকি লিখবার খাতাটার কয়েক পাতা বিড়বিড় করে পড়ার পর রজব আলী বলেন, ‘গরিবের মাজুর পোলা আমি। আটজন ভদ্রলোকের কাছে আমার পাওনা দাঁড়াইছে আড়াই হাজার টাকা। কেউই বাকি শোধ করতেছেন না। আমি ভাবনের কেডা? আপনারাই তো আমারে বিলাতি হোটেলের মালিক ভাবতেছেন।’
এসব উচ্চারণ শেষে বিস্ময়কর দৃশ্য। রজব হাঁক দেন, ‘ধনু, কই গেলি?’ দোকানের কিশোর বয়সি পরিচারক ধনু এগিয়ে এলে রজব বলেন, ‘বারী মামুরে চা-নাশতা খাইবার দে।’ বারী বলেন, ‘নানার বেটার দিলটা দেখলে? বিলকুল যেন কাপাস তুলা।’
২.
ওই যে দুপুরে সিদ্দিকুল হায়াত বারীর মেজাজটা খিঁচড়ে গিয়েছিল তার কারণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অফিসে এসেছিলেন তাঁর স্বজেলাতুতো ছোট ভাই বুলবণ ফারুক। বাণিজ্যিক অফিসগুলোয় স্টেশনারি সামগ্রী সরবরাহকারী বুলবণ ফারুক আট বছর আগে মায়ের যকৃতে গুরুতর অস্ত্রোপচারের খরচ জোগানোর জন্য দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন বারীর কাছ থেকে। কথা ছিল, টাকা ছয় মাসের মধ্যে শোধ করা হবে। কথা আর কাজ দোস্তি করেনি। অস্ত্রোপচারের পর ফারুকের মা প্রায় এগারো বছর বেঁচে ছিলেন। তবু টাকাটা ফেরত পেলেন না বারী।
‘খেয়ে পরে দিন তো যায় মোটামুটি’ পরিস্থিতিতে নিঃশ্বাস নিতে পারলেই আরামবোধ করেন বারী। তিনি তাই, ‘কিরে ভাই আমার টাকাটা তুই দিচ্ছিস না’ বলার মধ্যেই তাগদাকে সীমিত রেখেছেন। কড়া ভাষায় দুকথা শুনিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে কখনো কখনো যে হয় না, তা নয়। ইচ্ছেটা দমন করার প্ররোচনা দেয় ভদ্রতা। এতে যাঁর সুবিধা, অন্তরে তাঁর তাকধিনাধিন বাদ্য বাজায় শঠতার বীণা। কর্জের ইতিহাসকে গুরুত্ব তো বুলবণ ফারুক দিচ্ছিলেনই না, উপরন্তু মাসে কমপক্ষে দুবার এসে মুরুব্বির খবর নেওয়ার ভঙ্গি দিয়ে বারীর অফিসে কলা-বিস্কুট-চা খেয়ে যাচ্ছিলেন।
সেদিন দুপুরেও মুরুব্বি দর্শনে এসে ফারুক কলা-বিস্কুট-চা সাঙ্গ করলেন। সাঙ্গ করেন তবু ওঠেন না। একপর্যায়ে আমতা আমতা করে বলেন, ‘ভাইয়া! আপনার কি শরীর খারাপ?’ বারী জানান, শরীর নয়। মন খারাপ। জুন মাস যায় যায়, তবু মে মাসের বেতন হচ্ছে না। পাওনাদারদের মুখ দেখানোর সংকট ধেয়ে আসছে। ফারুক কপট বিস্ময়কর প্রকাশ করে বলেন, ‘মাই গড! এভাবে জীবন চলে? না ভাইয়া। আগের কোম্পানি ছেড়ে আপনার এখানে আসাটা ভুল হয়েছে। শুধু ভুল না। বিরাট ভুল! আগের কোম্পানি হয় তো এই কোম্পানির তুলনায় কম দিত। কিন্তু যা দিত সেটা তো টাইমলি দিত।’ বারীর মেজাজ গরম হচ্ছিল। মনে মনে বললেন, ‘গরুর গরু, ছ’মাসে শোধ দেওয়ার ওয়াদা করে নেওয়া টাকা আট বছরেও দিলি না। তোরে যে বাইশ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছি না, সেজন্য বাড়িতে গিয়ে নফল নামাজ আদায় না করে হাম্বা হাম্বা করছিস!’ বারীর প্রশ্ন, ‘আর কিছু বলবি?’
‘না। ভাইয়া!’ বলেন বুলবণ ফারুক, ‘যে কঠিন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন কীভাবে যে কথাটা বলি, ভেবে পাচ্ছি না। ইয়ে... মানে... ব্যাপারটা হয়েছে কী... আমার না হাজার দুয়েক টাকা খুবই দরকার। দিন প্লিজ! সামনের মাসের পনেরো তারিখের মধ্যে ফেরত পাবেন কোনো সন্দেহ নাই।’
সিদ্দিকুল হায়াত বারী বলেন, ‘এতক্ষণ ধরে আমার ক্রাইসিসের যে কেচ্ছা বললাম, সেগুলো কী তোরে বলেছি? না কি গোবরের নাদারে বলেছি?’
৩.
ভলতেয়ার রচিত ‘কাঁদিদ’ উপন্যাসে আছে, নায়ক কাঁদিদ অদ্ভুত অদ্ভুত দেশে চক্কর দেয়। একবার সে এমন এক দেশে যায়, যে দেশের মানুষ যুক্তিতর্কের পরোয়া না করে নিজের ঐতিহ্যকে আঠারো আনা গুরুত্ব দেওয়ার জন্য মরিয়া। কাঁদিদ ঘুরতে সেই দেশের একটা শহরে পৌঁছে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতে থাকে।
শহরের একটি জায়গায় কাঁদিদ দেখে হাজার হাজার মানুষ কিছু একটা দেখবার জন্য জড়ো হয়েছে। চক্রাকার জটলার মধ্যে সে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ভিড়ের প্রচণ্ড চাপ। কাঁদিদ এগোতে পারছিল না। সে এক ব্যক্তিকে বলে, ‘ভাই, এখানে কী হচ্ছে। এত ভিড় কেন?’ লোকটা বলে, ‘ফাঁসি দেওয়া হবে নৌকমান্ডারকে। ওটা দেখতে চায় এরা।’
কোন অপরাধে ফাঁসি? কাঁদিদের প্রশ্নের জবাবে লোকটি জানায়, এই কমান্ডার তাঁর জাহাজকে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে গোলাবর্ষণ করেননি। তাই প্রাণদণ্ডের হুকুম হয়েছে। কাঁদিদ বলেন, শত্রুপক্ষও তাদের নৌকমান্ডারের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ তুলে শাস্তি দিতে পারত। তা তো ওরা করছে না।
লোকটি বলে : তোমার কথায় যুক্তি আছে ভায়া। তবে প্রথা হলো, প্রতি বছর আমাদের দেশে একজন নৌকমান্ডারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেই ঐতিহ্যও তো আমাদের রক্ষা করা কর্তব্য।
৪.
কাঁদিদবিষয়ক গল্পটি শুনে সিদ্দিকুল হায়াত বারী বলেন, ‘দেশের ঐতিহ্য, নাকি পাগলামির ঐতিহ্য রক্ষার জন্য দিওয়ানা হওয়া?’ একদিন গ্রিল করা মুরগি খাওয়ানোর আয়োজন করেন তিনি। সেখানে মুরগি-শিয়ালসম্পর্কিত আত্মকেন্দ্রিকতার একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। রুশ গল্প সেটা। শিয়াল বাড়িতে এসে তার স্ত্রীকে বলে, এই নাও। বাঘ মামা দিয়েছে। আজ মামার জন্মদিন তো! তাই তিনি এই খাদ্য উপহার দিয়ে আমায় বলেছেন, যা এগুলো নিয়ে যা। তুই, তোর বউ আর তোর ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকে চারটি করে খাবি।
শিয়ালগিন্নি দেখে, স্বামী এনেছে আটটি মুরগি। সে বলে, বাঘ মামার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি বলে কি কিছু নেই? আমাদের পরিবারে মোট চার সদস্য। প্রত্যেকে চারটি করে খেতে হলে তো ষোলোটি মুরগি দরকার। উনি আটটি দিলেন কোন্ আক্কেলে? ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে গিন্নি।’ বলে শিয়ালকর্তা, ‘তবে চিন্তার কিছু নেই। কোনো সমস্যা হবে না। আমার ভাগের চারটি আমি আগেই খেয়ে নিয়েছি।’
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন