বন অধিদপ্তরের দেড় হাজার কোটি টাকার ‘সুফল’ প্রকল্পে দুর্নীতির খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকল্পে নয়ছয়, ভুয়া কাগজে অর্থ উত্তোলন, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অসংগতির নথিপত্র জব্দ করেছে সংস্থাটি। দুদক বলছে, নথিপত্র বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সময়ে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে।
জানা যায়, দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে সরকারি বনজ সম্পদ উন্নয়নে ২০১৮ সালে ‘টেকসই বন ও জীবিকা’ শীর্ষক ‘সুফল’ প্রকল্প গ্রহণ করে বন অধিদপ্তর। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বন মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের মাঠপর্যায়ে পদে পদে ঘটে অনিয়ম। সুফল প্রকল্প, বনায়ন প্রকল্প কিংবা রাজস্ব খাতের বরাদ্দের টাকা কাগজকলমে কাজ দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একইভাবে সিন্ডিকেটে পদায়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে শত শত কোটি টাকা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বনায়নের জন্য সুফল প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়িত হয়নি প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ। প্রকল্পের অধীনে গত দুই অর্থ বছরে ৮৭২ হেক্টর নার্সারি ও বনায়ন করার পরিকল্পনা থাকলেও উল্লেখযোগ্য অংশে তা করা হয়নি। কিছু এলাকায় শুধু সীমানা নির্ধারণের জন্য সামান্য চারা লাগানো হয়। রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা বিট এলাকায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫১০ হেক্টর বনভূমিতে নতুন বাগান সৃজনের বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে মাত্র ১৬০ হেক্টরে বনায়ন হয়েছে। একইভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩৬২ হেক্টর বনায়ন প্রকল্পেও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। বনায়নের প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থই কাজ না করে আত্মসাৎ করেছেন বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, অভিযান শেষে দুদকের দলটি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী কমিশন পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের প্রকল্পে অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতে বন অধিদপ্তরে অভিযান চালায়। বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সুফল প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৩ হাজার ৯৬০ হেক্টর এলাকায় বনায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের ২০ হাজার ১৩৬ হেক্টর বাদে বাকি ৮৩ হাজার ৮২৪ হেক্টর বনায়ন করা হয়েছে বন বিভাগের অধীনে অন্য ২৩ জেলায়। সুফল প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঢাকা বন বিভাগে ২ হাজার ৮১০ হেক্টর, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে ৯ হাজার ২৭৩ হেক্টর, চট্টগ্রাম দক্ষিণে ৮ হাজার ৬৭০ হেক্টর, চট্টগ্রামে ৯ হাজার ২১০ হেক্টর, ভোলায় ৮ হাজার ৪২০ হেক্টর, পটুয়াখালীতে ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর, সামাজিক বন বিভাগ রাজশাহীতে ১৭৭ হেক্টর, দিনাজপুরে ২ হাজার ৩০ হেক্টর, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারে ২৯০ হেক্টর, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামে ২ হাজার ৬২০ হেক্টর, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে ৮ হাজার ৪৬৮ হেক্টর, কক্সবাজার দক্ষিণে ১১ হাজার ৬৬৮ হেক্টর, ময়মনসিংহে ৪ হাজার ৪৪৩ হেক্টর, টাঙ্গাইলে ২ হাজার ৭১৩ হেক্টর, উপকূলীয় বন বিভাগ নোয়াখালীতে সবচেয়ে বেশি ১৯ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট বন বিভাগে ৪ হাজার ৬৪৮ হেক্টর এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ঢাকা বিভাগে ২০৫ হেক্টর বনায়ন করা হয়েছে। শেরপুরের নকশী সীমান্ত ফাঁড়িসংলগ্ন রংটিয়া রেঞ্জ এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাগানে মাত্র ১টি চাপালিশ গাছ টিকে আছে। এর সঙ্গে অন্যান্য গাছ থাকলেও বনের কোথাও বন্যহাতির আক্রমণের ছাপ নেই। প্রতিটি গাছ অক্ষত ও সতেজতার সঙ্গে ডালপালা মেলে ধরেছে।