নদীর পারে শান্ত-নিবিড় গ্রাম হাভাতিয়া। সেখানেই থাকেন পশু-প্রাণীপ্রেমী আবুল কাশেম। তার চারপাশ যেন এক ছোট চিড়িয়াখানা। সকাল হতেই আশপাশের গাছে জড়ো হয় বক, ঘুঘু, শালিক। কাশেম ডাকলেই উড়ে আসে বক, ঘুঘু ঝাঁপিয়ে নামে তার উঠানে। কেউ আসে খাবারের জন্য, কেউ স্নেহের টানে। কাশেম যেন পাখি ও বন্যপ্রাণীর অভিভাবক। খরগোশ, বিড়াল, কুকুর সবাই থাকে তার কাছে নিরাপদ আশ্রয়ে
নদীর নাম হাভাতিয়া। অবস্থান কুমিল্লার হোমনা ও তিতাস উপজেলায়। নদীটি পুরান বাতাকান্দিতে দুই উপজেলাকে ভাগ করেছে। উত্তর পারে হোমনা উপজেলার মহিষমারী গ্রাম। দক্ষিণ পারে পুরান বাতাকান্দি। নদীর উত্তর পারে একটি বাড়ি। যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সেই বাড়ির পাশে ছোট পুকুর। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে এক তরুণ। তিনি মুখে বকের ডাক তুলেছেন। ডাক শুনে পুকুরের উত্তর পার থেকে দুটি বক উড়ে আসে। কোনোটা তার কাঁধে কোনোটা হাতে বসেছে। তিনি হাতে রাখা পাত্র থেকে ছোট মাছ মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। সাদা বকের পাখার ঝাপটায় তরুণের চোখে মুখে খুশির দোল খেলে যায়। তিনি আবুল কাশেম ভূঁইয়া। ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি পাখি ও প্রাণীর প্রেমে মগ্ন। কোনো পাখি ও প্রাণীকে তিনি আটকে রাখেন না।
অসুস্থ পাখি ও প্রাণীকে উদ্ধার করে এনে চিকিৎসার পর তারা উড়ে চলে যায়। এই বক জোড়া দেড় মাস তার এখানে থাকে। এরকম তার এখানে ঘুঘু ও শালিকসহ নানান পাখি সেবা পায়। তিনি অসুস্থ ও অসহায় বিড়াল ও কুকুর বাড়িতে তুলে আনেন। বাড়িতে এক জোড়া খরখোশ, কবুতর ও বিড়াল রয়েছে। অনেকে নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে তার বাড়িতে এসে মানুষ ও পাখির ভালোবাসা দেখেন। সরেজমিন দেখা যায়, ঘরের দক্ষিণ জানালার পাশে আম গাছ। সেখানে নির্ভয়ে ডিমে তা দিচ্ছেন মা ঘুঘু। বাড়িটি পাখি ও প্রাণীর জন্য হয়ে উঠেছে নিরাপদ আশ্রয়। এ বাড়িতে আবুল কাশেম ভূঁইয়া, তার শিক্ষিকা স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন। সবাই পাখি ও প্রাণীর যত্ন করেন। টিনের চালা ও বেড়ার ঘর। পায়ের তলায় মাটি। তবে সেখানে সুখের অভাব নেই। তিনি পাখির যত্নের সঙ্গে অবসরে বসে যান দোতরা বা গিটার নিয়ে। তার সুরে গাইতে থাকেন আধ্যাত্মিক যত গান। তার সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে নুসরাত জাহান খাদিজা। সে বলে, ‘আমার বান্ধবীরা ও গ্রামবাসী আমাদের বাড়ির পশুপাখি দেখতে আসে। বাড়িটিকে তারা চিড়িয়াখানা বলে। বাবার সঙ্গে আমরা পাখিদের যত্ন নিই। আমাদের পাখির সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে।’ গ্রামের বাসিন্দা তাইজ মিয়া, আবু সায়েম সরকার ও মো. সাইফ বলেন, ‘কাশেমকে এলাকার মানুষ পাখিপ্রেমী বলে ডাকেন। তার বাড়ি পাখির অভয়ারণ্য। পাখিকে ডাকলে তার কাছে চলে আসে। পাখি ও প্রাণীকে ভালোবাসা একটি ব্যতিক্রম কাজ। আমরাও পাখি ও মানুষের খুনশুটি দেখতে যাই।’ আবুল কাশেম ভূঁইয়া জানান, তিন ভাই তিন বোনকে রেখে তার বাবা মারা যান। তখন তার বয়স ১০ বছর। তার মা তাদের বুকে আগলে রেখে বড় করেছেন। সে বছর তাদের বাড়ির পাশের মান্দার গাছ থেকে ঝড়ে একটি পাখির বাসা নিচে পড়ে যায়। পাখি কাছে এলে মুরগি তাড়া করে। সেই সময় ছানার জন্য পাখির আকুতি তার মনকে নাড়া দেয়। তিনি ছানাকে উদ্ধার করে কেঁচো এনে খাইয়ে দেন। তিনি তার মা-বাবার কথা মনে করেন। মনে করেন তার পরিবারের কথা। সেই থেকে তিনি পাখি ও প্রাণীর যত্ন শুরু করেন।
তিনি বলেন, ‘অনেক প্রাণী এক বছর পরে এসে তার বাড়ির পাশের গাছে থাকে। তিনি হাত বাড়ালে উড়ে হাতে বসে।’ বকের গল্পের বিষয়ে জানান, তিনি কিশোর বয়সেও বকের ছানা এনে পালন করে ছেড়ে দেন। তিতাসের এক এলাকায় শিকারিরা বকের বাসা ভেঙে ছানা নিয়ে যায়। তিনি প্রশাসনকে জানিয়ে সেটা বন্ধ করেন। এ রকম এক অভিযানে দুটি বকের ছানা ফেলে চলে যায় শিকারিরা। তিনি সেগুলো এনে লালন করছেন। ওরা রাতে গাছের ডালে থাকে। আশপাশের মাঠে গিয়ে খাবার খায়। তিনি ডাকলে আবার উড়ে চলে আসে।
তিনি বলেন, ‘কোথাও পাখি আহত হলে এলাকাবাসী আমার কাছে এনে দেন। আমি খাবার ও ওষুধ দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করি। তারপর আকাশে উড়িয়ে দিই।’ একবার মালিক কলাগাছ কেটে ফেলেন। পাতায় ছিল টুনটুনির বাসা। তিনি ছানা উদ্ধার করে তাদের পোকার ডিম সুইয়ের মাথায় নিয়ে খাইয়েছেন। কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, ‘পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য ও সুন্দর সমাজের জন্য পাখি ও প্রাণীর প্রতি যত্নের বিকল্প নেই। আবুল কাশেম তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তিনি একা বড় কাজ করতে পারবেন না। টিম গঠন করে পাখি ও প্রাণীর সেবায় একটি টিম গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন।’