মুদ্রা শুধু ধাতব টুকরো নয়। এটি একটি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। সেই মুদ্রাকেই জীবনের অংশ করে নিয়েছেন মো. সাইফুল ইসলাম সায়েম। তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী এবং দেশের অন্যতম মুদ্রা সংগ্রাহক। বর্তমানে তার সংগ্রহে আছে প্রায় ২৪০টি দেশের মুদ্রা এবং ৫০টিরও বেশি দেশের নোট।
জন্ম লক্ষ্মীপুরে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে ফার্মগেট ও তেজকুনিপাড়ায়ই কেটেছে তার শৈশব। মুদ্রা সংগ্রহের যাত্রা শুরু হয় প্রায় দুই দশক আগে ২০০৫ সালে। তখন তিনি ক্লাস সিক্সে পড়েন। এক দিন তার চাচা সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে উপহার দেন এক ডলারের পাঁচটি মুদ্রা। প্রথমবার বিদেশি মুদ্রা হাতে পেয়ে তিনি যেন অন্য জগতে হারিয়ে যান। পরদিন স্কুলে নিয়ে বন্ধুদের দেখান। আর সেখানেই শুরু হয় বিনিময়ের গল্প। একটি মুদ্রা দিয়ে আরেকটি দেশের মুদ্রা পাওয়া। সেখান থেকেই শুরু হয় এ সংগ্রহের পথচলা। বর্তমানে তার সংগ্রহে আছে প্রায় ২৪০টি দেশের ও অঞ্চলের মুদ্রা এবং ৫০টিরও বেশি দেশের নোট। এখানে ‘দেশ’ বলতে শুধু বর্তমান স্বীকৃত রাষ্ট্র নয় বরং বিলুপ্ত দেশ, নির্ভরশীল অঞ্চল, উপনিবেশ ও বিশেষ প্রশাসনিক এলাকার মুদ্রাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংগ্রহে রয়েছে পাকিস্তান আমলের বাংলাদেশি মুদ্রা, স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের সব পয়সা, আলোচিত লাল ১ টাকার মুদ্রা, বিলুপ্ত দেশ ও বিশেষ অঞ্চলের কয়েন, বিভিন্ন দেশের স্মারক নোট এবং বাংলাদেশের স্ট্যাম্প। যে কয়েনগুলো এখন আর তৈরি হয় না সেগুলোর মধ্যেও বিরল কিছু মুদ্রাও তার সংগ্রহে রয়েছে। অটোমান অ্যাম্পায়ার, সাউথ অ্যারাবিয়া, তিব্বত, রোডেশিয়া, যুগোস্লাভিয়া, ইউএসএসআর (সোভিয়েত ইউনিয়ন), বেলজিয়ান কঙ্গোসহ প্রায় ৩৫টি বিলুপ্ত দেশের মুদ্রা তিনি সংরক্ষণ করেছেন। এ ছাড়া কেম্যান আইল্যান্ডস, ফকল্যান্ড আইল্যান্ডস, জার্সি, জিব্রাল্টার, ম্যাকাও। ইত্যাদি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকার মুদ্রাও রয়েছে তার অ্যালবামে। সবচেয়ে গর্বের সংগ্রহ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন প্যালেস্টাইন ম্যান্ডেটের সম্পূর্ণ মুদ্রাসেট। ১৯৪৬ সালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দেশটির এই কয়েনগুলো এখন পাওয়া খুব কঠিন। বহু বছরের প্রচেষ্টায় এক মিল থেকে ১০০ মিলস পর্যন্ত ব্রোঞ্জ ও নিকেল মুদ্রার পুরো সেট সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তবে এই দীর্ঘ যাত্রা সহজ ছিল না। একবার বিদেশ থেকে ডাকযোগে আসা এক বিরল কয়েন খাম খুলে দেখেন, ভিতরটা খালি! সেই হতাশা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন সবসময় ট্র্যাকিং সুবিধা ব্যবহার করেন। আবার একবার এক বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা ‘অটোমান অ্যাম্পায়ার’ কয়েন পরে নকল বলে প্রমাণিত হয়। সেখান থেকে তিনি শিখেছেন, মুদ্রা সংগ্রহ মানেই গবেষণা ও যাচাইয়ের ধৈর্যের পরীক্ষা। তার সবচেয়ে আনন্দের অভিজ্ঞতা ছিল এক বিদেশি কালেক্টরের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত উপহার পাওয়া। অনলাইনে পরিচিত সেই ব্যক্তি হঠাৎ ডাকযোগে বিরল কিছু কয়েন পাঠান। খাম খুলে ঝকঝকে কয়েনগুলো দেখে সায়েমের মনে হয়েছিল, এ যেন বহুদিনের স্বপ্নপূরণ। সংরক্ষণ নিয়েও তিনি যত্নশীল। মুদ্রা ও নোট রাখেন বিশেষ অ্যালবাম ও জিপ-পলির ভিতরে। তিনি বলেন, ‘অনেকে পুরোনো কয়েন পানি বা কেমিক্যালে ধুয়ে চকচকে করেন, এটা ভুল। এতে কয়েনের আসল রং ও ঐতিহাসিক মান নষ্ট হয়।’ ২০২৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে তিনি নিজের সংগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। দর্শনার্থীরা তার সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন।
তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, নিজের একটি সংগ্রহশালা বা মিনি মিউজিয়াম তৈরি করা, যেখানে দেশ-বিদেশের মানুষ ইতিহাস জানতে পারবে। এ ছাড়া তিনি ডিজিটাল মিউজিয়াম (অনলাইন ডিসপ্লে) গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। এতে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ তার সংগ্রহ দেখতে পারে। তার লক্ষ্য কেবল সংগ্রহ নয়, বরং তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি চান নতুন সংগ্রাহকরা ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভালোবাসুক, কয়েনের মাধ্যমে অতীতকে চিনুক।
তার মতে, একটি মুদ্রা হাতে নিয়ে মনে হয়, এটি কোনো এক সময় কোনো মানুষের হাত ঘুরে এসেছে, কোনো বাজারে ব্যবহৃত হয়েছে, কোনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। মুদ্রার সেই ইতিহাসকেই জীবন্ত রাখছেন তিনি। এটি শুধু ব্যক্তিগত শখ নয়, এ যেন সময়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক চলমান ভান্ডার।