শীত মানেই কৃষিপল্লিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার। খেতজুড়ে সবুজের আবির্ভাব, কৃষকের মুখে হাসি। তবে যশোরের চৌগাছা সড়কের পাশের গ্রাম আব্দুলপুরের কৃষকদের গল্পটা একটু ভিন্ন। তারা নিজেরা সবজি ফলান না, বরং চাষ করেন সবজির চারা। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তুলেছেন এমন এক চারা উৎপাদন কেন্দ্র, যা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। রাস্তার দুই পাশে যতদূর চোখ যায়, দেখা মেলে পলিথিনে ঢাকা সবজি বীজতলার সারি। সকাল-সন্ধ্যা কৃষকরা ব্যস্ত বীজ বপন, পানি দেওয়া, রোগবালাই দমন ও চারার যত্নে। এখানে যেন প্রতিটি জমি একেকটি ক্ষুদ্র চারা তৈরির কারখানা। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুরুতেই আব্দুলপুরের কৃষকরা বীজতলা প্রস্তুত করেন। বাঁধাকপি, ফুলকপি, টম্যাটো, বেগুন, মরিচসহ নানান জাতের শীতকালীন সবজির বীজ বপন করা হয় এসব বীজতলায়। প্রায় এক মাসের পরিচর্যার পর চারা বিক্রির উপযোগী হয়। এরপরই শুরু হয় ব্যস্ততা। কৃষকরা চারা তুলছেন, মাটি ঝেড়ে রাখছেন, ক্রেতারা আসছেন, ট্রাকে বোঝাই হচ্ছে চারা, এ যেন এক উৎসবের আমেজ। এখন গ্রামজুড়ে শতাধিক কৃষক পেশাদারভাবে চারা উৎপাদনে নিয়োজিত। চারা বিক্রির মৌসুম শুরু হয় আগস্টের মাঝামাঝি। চলে মার্চ পর্যন্ত। এই সময় দূরদূরান্ত থেকে কৃষক ও পাইকাররা আসেন চারা কিনতে। যশোরের পাশের ঝিকরগাছা, গদখালী, নাভারণ, চৌগাছা, মণিরামপুর ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও সাতক্ষীরার কৃষকরা এখান থেকেই সংগ্রহ করেন চারা। অনেকেই এখন অনলাইন পেজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চারা বিক্রি করছেন। এতে স্থানীয় বাজার ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সহজেই ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে মানভেদে ফুলকপির প্রতি হাজার চারা বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায়, বাঁধাকপির চারা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়, আর টম্যাটো ও বেগুনের চারা ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়। অন্যান্য সবজির চারা প্রতি পিস ১ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাষিরা জানিয়েছেন, চারা উৎপাদন ব্যয়বহুল হলেও লাভও কম নয়। গড়ে প্রতি ছয় মাসে একজন কৃষক ১ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিট লাভ করতে পারেন। অনেকেই জমি ভাড়া নিয়ে চারা উৎপাদন করছেন এবং এখন তা তাদের প্রধান জীবিকা হয়ে উঠেছে। সহযোগিতা করছে যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। মানসম্মত চারা উৎপাদনের জন্য আধুনিক পদ্ধতি ও রোগনিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির প্রশিক্ষণও মিলছে সহজে। বর্তমানে আব্দুলপুর ও পার্শ্ববর্তী বাগডাঙ্গা গ্রামে প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজির বীজ রোপণ করা হয়। এখান থেকে বছরে উৎপাদিত হয় ৩০ কোটি উন্নতমানের চারা, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। চারা বিক্রির এই বাণিজ্য স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি এনেছে। তরুণ প্রজন্মও এখন এতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কেউ কেউ উন্নত জাতের বিদেশি বীজ এনে পরীক্ষামূলকভাবে চারা উৎপাদন করছেন।
মানসম্মত চারা, সাশ্রয়ী দাম ও কৃষকদের নিষ্ঠার কারণে এখন দেশের নানান অঞ্চলের কৃষক আব্দুলপুরের চারার ওপর আস্থা রাখেন। যশোরের আব্দুলপুর আজ শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি দেশের অন্যতম ‘সবজির চারা রাজ্য’। এখানকার মাটিতে অঙ্কুরিত হচ্ছে ভবিষ্যতের ফসল, আর কৃষকের ঘামে বেড়ে উঠছে সবুজ আশার চারা।