উত্তরাঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জনপদ দিনাজপুর। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমূল্য ভান্ডার। এই জেলার তিনটি উপজেলার মিলনস্থলে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থান- আমবাড়ী হাট। বহু বছর ধরে এ হাট শুধু পণ্য বিনিময়ের কেন্দ্র নয়; বরং হয়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি, ব্যবসা ও শিক্ষার প্রাণস্পন্দন...
প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটারের আমবাড়ী হাটটি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তফাপুর, চিরিরবন্দর উপজেলার পুণট্টি ও ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় আমবাড়ীর দৈনন্দিন চালচিত্রের অনেকটাই জেলা শহরের মতো। স্থানীয়রা চান আমবাড়ী একটি উপজেলা হোক। পার্বতীপুরের মোস্তাফাপুর ইউপির তহসিলদার রবিউল ইসলাম জানান- ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে জানা যায়, ১৮৮৮ ইং সালে ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হওয়া সেটেলমেন্ট/সিএস-জরিপে আমবাড়ী নামে কোনো মৌজা/গ্রাম না থাকায় ছোটরামচন্দ্রপুর মৌজায় (১) খতিয়ানভুক্ত দুই দাগে ৮৭ শতক জমি আমবাড়ী হাটের নামে রেকর্ড করা হয়। ওই রেকর্ডেই সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার হাটবারের নাম উল্লেখ রয়েছে। এটি এখনো চলমান। হাট থেকে সরকারের প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। সপ্তাহে দুই দিন হাট বসলেও অন্য দিনগুলোতে বাজার বসে। আমবাড়ী হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুটি মহাবিদ্যালয় ও একটি ফাজিল মাদরাসা। আছে প্রায় ২৫-২০টি কওমি মাদরাসা ও এতিমখানা। আরও আছে ছোট-বড় ২০টির মতো কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও কয়েকটি প্রাইভেট কলেজ। বাজারে রয়েছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। রয়েছে ব্যাংক, বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এটি এখন বাণিজ্যিক নগরী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও আলাদা আলাদা ইউনিয়ন ও উপজেলার আওতাধীন অংশে পড়েছে। বিচিত্র এ জনপদের ডাকঘরটি চিরিরবন্দরে, চিকিৎসা কেন্দ্রটি পার্বতীপুরে এবং একাংশ ফুলবাড়ীতে পড়েছে। এখানে ঐতিহ্যবাহী আমবাড়ী মেলা সবশেষ বসেছিল ২০১৪ সালে। আমবাড়ীর অদূরে বেশ কিছু পদ্মপুকুর রয়েছে। এখানেই আছে আদিবাসী সাঁওতাল ও বাঙালিদের শত বছরের সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থান। এখানে ২০১৭ সালে সম্ভাব্য লৌহ খনির অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল। স্থানীয় আমবাড়ী ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আফসার আলী খান জানান, ‘প্রতিবছর কোরবানির সময় মাসব্যাপী হাটটিতে ব্যাপক গরু, ছাগল, ও মহিষের ক্রয়-বিক্রয় হয়।’ পশু ছাড়াও সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার আমবাড়ী হাটে বসে তরকারি ও কৃষিপণ্যের বিশাল হাট। এ ছাড়াও এই হাটকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি বিপণি বিতান। আমবাড়ী হাটের নামকরণে নানান কথা রয়েছে। নামকরণ বিষয়ে এই হাটের পুরাতন বাইসাইকেল ও পরে ঘড়ির মেকার শতবর্ষী প্রবীণ শ্রী অমিত্ব মেকার জানান, বর্তমানে যেখানে বাজারের বড় মসজিদ অবস্থিত, সেখানে বড় বড় দুটি আমের গাছ ছিল। তখনকার সময় বাইরের অন্য জেলার ফেরি ব্যবসায়ীরা দিনের বেলায় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ব্যবসা করে রাতে এসে ওই আম গাছের নিচে রাতযাপন করতেন। সম্ভবত তাদের দেওয়া আমবাড়ী বা আমতলায় থাকা নাম থেকেই পরে আমবাড়ী নামকরণ হয়েছে।