১২ জুন ভারতের আহমদাবাদে টেক-অফের পর মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া বিমান সারা বিশ্বকে কাঁদাচ্ছে। নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে বিমান দুর্ঘটনার ভয়াবহতার কথা। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা ছাড়াও বিশ্বজুড়ে ঘটে গেছে ভয়ংকর কতগুলো বিমান দুর্ঘটনা। যার প্রতিটি ঘটনাই একটি আলাদা অধ্যায়, একটি শিক্ষা, আর একটি ব্যর্থতার গল্প। এ নিয়েই আজকের রকমারি-
টেনেরিফ বিমানবন্দর বিপর্যয়
তারিখ : ২৭ মার্চ, ১৯৭৭ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, স্পেন, মৃত্যু : ৫৮৩ জন
এটি সাধারণ কোনো বিমান দুর্ঘটনা ছিল না। এটিকে বলা হয় বিমানবন্দর বিপর্যয়। বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা এটি। ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ, স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লস রোদেওস বিমানবন্দরে এ ঘটনা ঘটে। এর বর্তমান নাম টেনেরিফ নর্থ এয়ারপোর্ট। এ মর্মান্তিক ঘটনায় দুটি বড় যাত্রীবাহী বোয়িং ৭৪৭ বিমান পরস্পরের সঙ্গে রানওয়েতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যাতে মোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু হয়। দুটি বিমান-কেএলএম ফ্লাইট ৪৮০৫ এবং প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১৭৩৬- অন্য একটি দ্বীপে অবতরণ করার কথা ছিল, কিন্তু একটি বোমা বিস্ফোরণের কারণে তাদের টেনেরিফের লস রোদেওস বিমানবন্দরে ঘুরিয়ে আনা হয়। এ স্থানান্তরের ফলে বিমানবন্দরে অতিরিক্ত ভিড়, কুয়াশা এবং যোগাযোগ বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনাটি ঘটে যখন ঘন কুয়াশার মধ্যে কেএলএম বিমানের পাইলট টেক-অফের অনুমতি না পাওয়া সত্ত্বেও রানওয়েতে ছুটতে শুরু করেন। একই সময়ে প্যান অ্যাম বিমানের পাইলটরা ওই একই রানওয়ের ওপর থাকায়, দুটি বিশাল বোয়িং ৭৪৭ পরস্পরের সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা খায়। কেএলএম বিমানের সব যাত্রী ও ক্রু এবং প্যান অ্যাম বিমানের অধিকাংশ যাত্রী এতে প্রাণ হারান। তদন্তে জানা যায়, মূলত ভুল বোঝাবুঝি এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে অস্পষ্ট যোগাযোগ এ দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল। কেএলএম পাইলট ভেবেছিলেন যে তারা টেক-অফের অনুমতি পেয়েছেন, কিন্তু আসলে তা স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। একই সঙ্গে কুয়াশার কারণে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না এবং রানওয়েতে থাকা প্যান অ্যাম বিমানের অবস্থান স্পষ্ট ছিল না।
জাপান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১২৩
তারিখ : ১২ আগস্ট, ১৯৮৫ টোকিও, জাপান, মৃত্যু : ৫২০ জন
জাপান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১২৩ কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ছিল না। এটি মূলত ছিল একটি অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী বিমান। যেটি ১৯৮৫ সালের ১২ আগস্ট টোকিওর হানেদা বিমানবন্দর থেকে ওসাকার ইটামি বিমানবন্দরের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে। বিমানটি ছিল বোয়িং ৭৪৭ এসআর-৪৬ মডেলের এবং তাতে ৫২৪ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য ছিলেন। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই বিমানের পেছনের প্রেসার বাল্কহেড হঠাৎ করে ভেঙে যায়। এ ভাঙনের ফলে বিমানের সমস্ত হাইড্রোলিক সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়ে, ফলে পাইলটরা বিমান নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম হয়ে যান। তবে তখনো তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিমানটি আকাশে প্রায় ৩২ মিনিট ধরে নড়াচড়া করতে থাকে। আর পাইলটরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন এটিকে নিরাপদে অবতরণের জন্য। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত এটি জাপানের গুনমা প্রদেশের এক পর্বতাঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় ৫২০ জন নিহত হন এবং মাত্র চারজন যাত্রী অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। এটি বেসামরিক বিমান চলাচলের ইতিহাসে একক কোনো বিমানের সবচেয়ে বড় প্রাণহানির ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। পরে তদন্তে জানা যায়, ১৯৭৮ সালে একই বিমানের লেজে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল এবং তখন যে মেরামত করা হয়েছিল, তা ভুলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। এই ত্রুটিপূর্ণ মেরামতের কারণে প্রেসার বাল্কহেড দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তা ফেটে গিয়ে বিমানটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বিশ্বজুড়ে বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা হয়।
চরখি দাদরি আকাশপথ সংঘর্ষ
তারিখ : ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ হরিয়ানা, ভারত, মৃত্যু : ৩৪৯ জন
১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের চরখি দাদরি নামক স্থানে আকাশপথে সংঘর্ষ একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। এ দুর্ঘটনায় দুটি যাত্রীবাহী বিমান মাঝ আকাশে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় এবং এতে ৩৪৯ জন নিহত হন। এটি এখনো পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী মাঝ আকাশে সংঘর্ষের ঘটনা হিসেবে পরিচিত।
সেদিন দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান উড্ডয়ন করছিল দাম্মামের উদ্দেশে। একই সময়ে কাজাখস্তান এয়ারলাইনসের একটি বিমান দিল্লিতে অবতরণের জন্য নিচে নামছিল। সৌদি বিমানের নির্ধারিত উচ্চতা ছিল ১৪ হাজার ফুট এবং কাজাখস্তান বিমানের থাকার কথা ছিল ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। কিন্তু কাজাখ পাইলটরা ভুল করে নির্ধারিত উচ্চতার নিচে নেমে আসেন এবং তারা সরাসরি সৌদি বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষের ফলে দুটি বিমান আকাশেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং ধ্বংসাবশেষ চরখি দাদরি গ্রামের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। উভয় বিমানের সব যাত্রী এবং ক্রু সদস্য নিহত হন। কাজাখ বিমানের একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কয়েক মুহূর্ত জীবিত ছিলেন, কিন্তু পরে তিনিও মারা যান। তদন্তে জানা যায়, কাজাখ পাইলটদের ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা ছিল এবং তারা দিল্লির এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের নির্দেশ ভালোভাবে বুঝতে পারেননি। সেই সঙ্গে বিমানে তখনো আধুনিক সংঘর্ষ প্রতিরোধক প্রযুক্তি ছিল না, যা এ দুর্ঘটনা এড়াতে পারত। যদিও এখন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এ ধরনের সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব।
টার্কিশ এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৯৮১
তারিখ : ৩ মার্চ, ১৯৭৪ প্যারিস (টার্কিশ এয়ারলাইনস), মৃত্যু : ৩৪৬ জন
টার্কিশ এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৯৮১ ছিল একটি আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী ফ্লাইট, যা ১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ প্যারিসের বাইরে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিমানটি তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। মাঝখানে যাত্রাবিরতির জন্য প্যারিসে অবতরণ করে। ফ্লাইটটি ছিল একটি ম্যাকডোনেল ডগলাস ডিস-১০ বিমান, যা সে সময়ের নতুন এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি বড় আকারের জেট। প্যারিস থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই বিমানটির কার্গো দরজা হঠাৎ করে খুলে যায়। দরজাটি ঠিকভাবে বন্ধ না হওয়ায় প্রেসারাইজড কেবিনে তীব্র চাপের পরিবর্তন ঘটে এবং মেঝের একটি অংশ ভেঙে যায়। এর ফলে বিমানের গুরুত্বপূর্ণ কন্ট্রোল কেবলগুলো কেটে যায় এবং পাইলটরা বিমানটির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বিমানটি বনাঞ্চলে বিধ্বস্ত হয় এবং এতে বিমানে থাকা ৩৪৬ যাত্রী ও ক্রু সবাই প্রাণ হারান।
এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট এআই১৭১
তারিখ : ১২ জুন, ২০২৫, আহমদাবাদ, ভারত, মৃত্যু : ২৭৯ জন (সর্বশেষ তথ্য)
১২ জুন দুপুরে ভারতের আহমদাবাদে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় লন্ডনের গ্যাটউইকগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় অন্তত ২৪১ জন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। উড়োজাহাজটিতে মোট ২৪২ যাত্রী ও ক্রু সদস্য ছিলেন, যাদের মধ্যে ৫৩ জন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন।
এই ফ্লাইটটি স্থানীয় সময় ১৩:৩৯ মিনিটে আহমদাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই বিধ্বস্ত হয়। উড্ডয়নের এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে উড়োজাহাজটির সংকেত হারিয়ে যায়। বিমানটি প্রায় ৬২৫ ফুট (১৯০ মিটার) উচ্চতায় থাকাকালীন সর্বশেষ সংকেত পাওয়া গিয়েছিল। উড়োজাহাজটি মেঘানি নগর নামের একটি আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এটি একটি ডাক্তারদের হোস্টেলে আঘাত হানে। তবে সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা ২৭৯ ।
এয়ার ইন্ডিয়া সূত্র জানিয়েছে, উড়োজাহাজটিতে মোট ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে ৫৩ জন ব্রিটিশ, ১৬৯ জন ভারতীয়, ১ জন কানাডিয়ান এবং ৭ জন পর্তুগিজ নাগরিক। বিমানটি ছিল একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, যার মোট আসন সংখ্যা ছিল ২৫৬টি।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্রিটিশ নাগরিকের নাম বিশ্বাস কুমার রমেশ বলে জানা গেছে, যিনি উড়োজাহাজটির ১১এ আসনে বসেছিলেন। আহমদাবাদ বিমানবন্দরের একটি সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বিমানটি রানওয়েতে গতি নিয়ে উড়াল দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে সবকিছু স্বাভাবিক লাগছিল, কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কয়েক সেকেন্ড পর উড়োজাহাজটি উড়ে যায়। তখনো কোনো অশুভ ইঙ্গিত ছিল না।
এরপরই দেখা যায়, উড়োজাহাজের উচ্চতা বাড়ছে না, যেটা এ ধরনের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের জন্য স্বাভাবিক নয়। কয়েক সেকেন্ড সমান্তরালভাবে ওড়ার পর এটি দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, এ ফ্লাইট আর গন্তব্যে পৌঁছবে না। এরপরই উড়োজাহাজটি রানওয়ের শেষ প্রান্ত থেকে কিছুটা দূরে একটি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর সজোরে ধাক্কা দিয়ে আছড়ে পড়ে।
এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৪৭
তারিখ : ৩১ মে, ২০০৯ প্যারিস (টার্কিশ এয়ারলাইনস) মৃত্যু : ২২৮ জন
২০০৯ সালের ৩১ মে রাতের ঘটনা। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো থেকে ফ্রান্সের প্যারিস অভিমুখে যাত্রা করে যাত্রীবাহী বিমান এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৪৭। বিমানটি ছিল একটি অত্যাধুনিক এয়ারবাস এ-৩৩০-২০৩ এবং এতে ২১৬ যাত্রী ও ১২ জন ক্রু সদস্য ছিলেন। স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১৪ মিনিটে ফ্লাইটটি রিও ডি জেনেইরো থেকে ছাড়ে। কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় এটি হঠাৎ করে রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরদিন সকালে জানা যায়, বিমানটি মাঝ সমুদ্রে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং সব যাত্রী ও ক্রু সদস্য নিহত হয়েছেন। প্রথমদিকে বিমানটি কেন বিধ্বস্ত হয়েছে তা স্পষ্ট ছিল না, কারণ দুর্ঘটনার স্থান ছিল সমুদ্রের গভীর অংশে এবং দুর্ঘটনার পরে অনেক দিন পর্যন্ত ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে জানা যায়, বিমানের পিটটিউব নামক যন্ত্র, যা গতির তথ্য দেয়, সেটি উচ্চতায় বরফ জমে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে বিমানটি ভুল গতির তথ্য দিতে শুরু করে এবং স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যায়।
লায়ন এয়ার ফ্লাইট ৬১০
তারিখ : ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ জাভা সাগর, মৃত্যু : ১৮৯ জন
লায়ন এয়ার ফ্লাইট ৬১০ ছিল একটি অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী ফ্লাইট। যেটি ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে পাংকাল পিনাং শহরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। ফ্লাইটটি একটি নতুন বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ মডেলের বিমান ছিল, যেটি উড্ডয়নের মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যেই জাভা সাগরে বিধ্বস্ত হয়। এতে থাকা ১৮৯ যাত্রী ও ক্রু সদস্যের কেউই বেঁচে ফেরেননি। এটি ছিল বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের প্রথম বড় দুর্ঘটনা এবং বিশ্বের বিমান নিরাপত্তা ইতিহাসে এক গভীর আলোড়ন তোলা ঘটনা। দুর্ঘটনার তদন্তে জানা যায়, বিমানে থাকা এমসিএএস নামের একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম এই বিপর্যয়ের জন্য মূলত দায়ী ছিল। এমসিএএস ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে বিমানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নাক নিচে নামাতে পারে যখন এটি বেশি তীব্রভাবে ওপরে উঠতে শুরু করে। কিন্তু বিমানের নাকের ঢাল নির্ধারণের জন্য যে সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি ভুল তথ্য দিচ্ছিল। ফলে সিস্টেমটি বারবার ভুলভাবে সক্রিয় হচ্ছিল এবং বিমানটিকে জোর করে নিচে নামাতে থাকছিল, যদিও পাইলটরা বারবার সেটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এয়ারলাইনসের রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা এবং পাইলটদের এমসিএএস সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকাও এ দুর্ঘটনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৩০২
তারিখ : ১০ মার্চ, ২০১৯ আদ্দিস আবাবা, ইথিওপিয়া, মৃত্যু : ১৫৭ জন
২০১৯ সালের ১০ মার্চ। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৩০২। এটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী ফ্লাইট। যেটি ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা থেকে কেনিয়ার নাইরোবি শহরের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে। উড্ডয়নের মাত্র ৬ মিনিট পর বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভেঙে পড়ে এবং এতে থাকা ১৫৭ যাত্রী ও ক্রু সদস্যের কেউই বেঁচে যাননি। এটি ছিল বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ মডেলের দ্বিতীয় বড় দুর্ঘটনা, যা ঠিক আগের বছরের লায়ন এয়ার ফ্লাইট ৬১০-এর অনুরূপ পরিস্থিতিতে ঘটে। এ দুটি দুর্ঘটনা মিলিয়ে বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
দুর্ঘটনার তদন্তে দেখা যায়, এই বিমানেও এমসিএএস নামক একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম ছিল, যা বিমানের নাক বেশি ওপরে উঠলে তা নিচের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু বিমানের নাকের ঢাল পরিমাপের জন্য যে সেন্সর ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং ভুল তথ্য পাঠাতে থাকে। ফলে এমসিএএস বারবার সক্রিয় হয়ে বিমানটিকে জোর করে নিচে নামাতে থাকে, যদিও পাইলটরা বারবার সেটি ঠেকানোর চেষ্টা করেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাইলটদের এই সিস্টেম সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ও প্রশিক্ষণ ছিল না। বোয়িং এ সিস্টেমটি বিমানটিতে সংযোজন করলেও পাইলট ম্যানুয়াল বা প্রশিক্ষণে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। ফলে পাইলটরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন।
আজারবাইজান এয়ারলাইনস ই ১৯০
তারিখ : ২৫ ডিসেম্বর, ২০০৪ বাকু, আজারবাইজান, মৃত্যু : ৭৪ জন
২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর আজারবাইজান এয়ারলাইনস ই ১৯০ দুর্ঘটনা ছিল এক হৃদয়বিদারক বিমান দুর্ঘটনা। আজারবাইজান এয়ারলাইনসের একটি ই ১৯০ বিমান রাজধানী বাকু থেকে নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলের উদ্দেশে রওনা দেয়। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই পাইলটরা বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির ইঙ্গিত পেয়ে ব্যাক-টু-বেস সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিমানের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। আর সে কারণে বিমানের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এরপরও পাইলটরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। এরপর বিমানটি বাকুর উপকণ্ঠে একটি খোলা এলাকায় ভেঙে পড়ে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা সব যাত্রী ও ক্রু সদস্য- মোট ৭৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথমে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করেন, এরপর সরকারি বাহিনী ও উদ্ধারকর্মীরা আসে। দুর্ঘটনার তীব্রতা এতটাই ছিল যে বেশির ভাগ দেহ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পরপরই আজারবাইজান সরকার একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, ইঞ্জিনে থাকা একটি মূল যন্ত্রাংশে ঝামেলা দেখা দেয়, যার কারণে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে আগুন লাগে। তা ছাড়া বিমানের ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার ও ককপিট ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার করা হয়েছে এবং বিশ্লেষণ চলছে বলে জানায় তদন্তকারী দল।
বিমান বাংলাদেশের ফকার এফ২৭-৬০০
তারিখ : ৫ আগস্ট, ১৯৮৪ ঢাকা, বাংলাদেশ, মৃত্যু : ৪৯ জন
১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট। এ ঘটনাটি বাংলাদেশের। যেটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা। সেদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফকার এফ২৭-৬০০ বিমানটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় আসছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণ করার সময় বিমানটি বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি জলাভূমির মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। সেদিনের আবহাওয়া একদমই বিরূপ ছিল। প্রচুর বাতাস আর ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বিমানের পাইলট দূরের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তখন রেডিও যোগাযোগের মাধ্যমে বিমানটি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে অবতরণের জন্য ৩২ নম্বর রানওয়ে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কিন্তু রানওয়ে দেখা না যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে পাইলট বুঝতে পারেন তিনি দিক ভুল করেছেন। ফলে অবতরণ না করে আবার উড়ে যান। দ্বিতীয় দফায় আইএলএস ব্যবহার করে অবতরণ করার চেষ্টা করেন। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে রানওয়ে ১৪-তে অবতরণের নির্দেশনা নেওয়া হয়। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়াতে সেটিও ব্যর্থ হয়। তৃতীয়বার অবতরণ করার সময় বিমানটি রানওয়ে থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে এক ডোবায় বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে পূর্বনির্ধারিত ঘরোয়া যাত্রী ফ্লাইট পরিচালনা করছিল। এতে চার ক্রু ও ৪৫ যাত্রীসহ সবাই নিহত হন।