ঐতিহাসিক ছয় সাগরের জেলা দিনাজপুর। পৌরাণিক কাহিনির জেলা দিনাজপুরে রাজার আমল থেকে চলে আসা ছয়টি ঐতিহ্যবাহী দিঘি সাগর নয়; তবু সাগর নামেই পরিচিত। ঐতিহাসিক দিঘিগুলো হলো- রামসাগর, পদ্মসাগর, সুখসাগর, মাতাসাগর, আনন্দসাগর ও জুলুমসাগর
রামসাগর : মধ্যযুগের বিখ্যাত সামন্ত রাজার অমর কীর্তি রামসাগর যা বাংলার এক অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক দিঘি। দিনাজপুর শহর থেকে ৮ কিমি দক্ষিণে আছে দিনাজপুরের মহারাজাদের কীর্তিময় রামসাগর। পাড়ভূমিসহ এ দিঘির মোট জমির পরিমাণ ১৪৬ একর। দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৩৯৯ ফুট এবং প্রস্থ ৯৯৮ ফুট। গভীরতা গড়ে প্রায় ৯ মিটার, সর্বোচ্চ পাড়ের উচ্চতা প্রায় ১৩৫০ মিটার। রামসাগরের দৈর্ঘ্য ১১৮০ গজ ও প্রস্থ ৩২০ গজ। এ ছাড়াও আছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা। রয়েছে শিশুদের জন্য পার্ক। উল্লেখ্য, সেচ-সুবিধা, প্রজাদের পানির কষ্ট দূরীকরণ এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের কাজের বিনিময়ে খাদ্যের সংস্থান হিসেবেই রাজা রামনাথের আমলে এ দিঘিটি খনন করা হয়। ১৭৫০ সাল থেকে ১৭৫৫ সালের মধ্যে ঐতিহাসিক রামসাগর দিঘি খনন করা হয়। তৎকালীন রাজা প্রাণনাথ এলাকাবাসীর জলকষ্ট নিবারণের জন্য বিশাল আকৃতির দিঘিটি খনন করেছিলেন। এলাকায় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, দিঘিতে পানি না ওঠার কারণে স্বপ্নে তার পুত্র রামনাথকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজা প্রাণনাথ হাতির বহর, ঘোড়ার বহর নিয়ে, ঢাক-ঢোল কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে রামসাগরে উপস্থিত হন এবং পুত্রকে স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুযায়ী পুকুরে নামতে বলেন। পুত্র রামনাথ যতই নিচে নামতে থাকেন ততই দিঘিতে জলধারা বাড়তে থাকে। অবশেষে প্রিয় পুত্র রামনাথের সলিল সমাধির মধ্য দিয়ে রাজা প্রাণনাথের খননকৃত বিশাল দিঘি জনগণের কল্যাণে বিশাল জলধারাসমৃদ্ধ দিঘিতে পরিণত হয়। প্রাণনাথের আত্মবিসর্জনের কারণে এই দিঘির নাম হয় রামসাগর। তখন থেকেই রামনাথের প্রতি শ্রদ্ধার অংশ হিসেবে প্রতি বছর মাঘ মাসের পঞ্চম তিথিতে বারুণি মেলা, গঙ্গাপূজা, সরস্বতীপূজা ও দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়ে থাকে। রামসাগর বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আসে ১৯৬০ সালে। তবে এর জলরাশি দেখভাল করে জেলা প্রশাসন। ১৯৯৫-৯৬ সালে এই দিঘিকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ২০০১ সালে রামসাগরকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয়।
পদ্মসাগর : দিনাজপুরের রাজবাড়ির ভিতরে অবস্থিত পদ্মসাগর। জানা যায়, এখানে রাজবাড়ির নারী ও রাজ কুমারীরা স্নান করতেন। বাঁধানো ঘাট ও গভীরতার জন্য পদ্মপুকুরটিকেও অনেকে সাগর বলে থাকেন। তবে এটি আয়তনে ছোট। রাজবাড়ির ভিতরে রানি ভবনের সঙ্গে পদ্মসাগরটি এখন মানুষকে আকৃষ্ট করে। তবে রাজবংশের কোন রাজা কোন সময় পদ্মপুকুর খনন করেছিলেন তা জানা যায়নি। পুকুরটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। এর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২১০ মিটার ও প্রস্থ ৭৭ মিটার। গভীরতা আনুমানিক ১-১.৫ মিটার। রাজবাড়িতে কমপক্ষে পাঁচটি মন্দির ছিল। সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হতো, আর সে কারণে প্রয়োজন পড়ত প্রচুর ফুল। শোনা যায়, পূজার জন্য পদ্ম ফুলের চাহিদা ছিল। ফুলের জোগান নিয়মিত রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ পুকুরে তাই পদ্ম ফুলের চাষ করা হতো। ফুলও ফুটত অনেক। আর সেই থেকে পুকুরের নামই হয়ে যায় পদ্মপুকুর। তবে পরবর্তীতে এটিকে পদ্মসাগর বলেও কেউ কেউ অভিহিত করেন।
সুখসাগর : দিনাজপুর শহর থেকে সড়কপথে উত্তর- পূর্বদিকে ২ কিলোমিটার দূরে রাজবাটি অবস্থিত। আর রাজবাটি থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে এই ‘সুখসাগর’ অবস্থিত। চারদিকে শাল ও আকাশমণি বাগান আর দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। স্বচ্ছ জলরাশি, দিঘিতে মাছের সাঁতার কাটা ও লাফালাফি এই সাগরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। নৌকায় চড়ে সাগরে ভ্রমণের কিছুটা স্বাদও নেওয়ার সুযোগ আছে এখানে। সাগরের পাড় যেন ছোট একটা পাহাড়ের মতো। শীতকালে বসে অতিথি পাখিদের মেলা। পাড়ে দাঁড়ালেই শোনা যাবে অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত পরিবেশ। অতিথি পাখিদের কোলাহলে মুখরিত হয় সুখসাগর। সুখসাগরটিকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে সুখসাগর ইকোপার্ক। যেখানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তথা পরিবেশ উন্নয়নে পাখির অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। সুখসাগরের আয়তন ২২.৪৪ একর। এখানে পিকনিক ও ট্যুরিস্ট স্থান তৈরি করা হয়েছে।
মাতাসাগর : দিনাজপুরের রাজা রামনাথের সময়ে খনন করা হয়েছে মাতাসাগর। সুখসাগর থেকে উত্তরে এই দিঘির অবস্থান। দিনাজপুর সদর উপজেলায় ৪৫.৬০ একর জমিতে অবস্থিত। এই সাগরপাড়ের উচ্চতা কম কিন্তু বিস্তৃতি অনেক বেশি। মাতাসাগরের নৈসর্গিক পরিবেশ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। যদিও এখন পাড়ের উচ্চতা কমে গেছে। এই মাতাসাগরকে লিজ দেওয়ার পর থেকে দর্শনার্থীদের যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
আনন্দসাগর : দিনাজপুর শহরের কাছেই আনন্দ সাগরের অবস্থান। এখানে প্রতিবছর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গোষ্ঠ পূজা করেন এবং এক দিনের মেলাও বসে। জনশ্রুতি আছে, দিনাজপুরের তৎকালীন রাজা রামনাথ রানিকে নিয়ে সোনার নৌকায় রাজবাড়ি থেকে পানিপথে নৌবিহারে এই দিঘিতে আসতেন। এজন্যই এর নাম হয়েছে আনন্দসাগর। আনন্দসাগরের সঙ্গে একটি নালার মাধ্যমে সুখসাগরের সংযোগ ছিল। যদিও পানি প্রবাহের নালাটি আগের মতো নেই।
বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘরসহ দখলের কারণে নালাটি অস্তিত্ব সংকটে। তাই এখন আনন্দসাগরের সঙ্গে নালার সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এটি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের উত্তরে এর অবস্থান। ৭ একর আয়তনের এই দিঘির গভীরতা তুলনামূলক কম। বর্তমানে আনন্দসাগরে মাছ চাষ করা হয়। কোনো সংস্কার না করায় পাড়গুলো বিলীনের পথে। আগে বিভিন্ন জাতের গাছগাছালি থাকলেও এখন নেই বললেই চলে। এখানে একটি গোষ্টধাম ও একটি মন্দির রয়েছে।
জুলুমসাগর : ইতিহাসবেত্তা মরহুম মেহরাব আলীর বই থেকে জানা যায়, জুলুমসাগর দিনাজপুর গোর-ই-শহীদ বড় ময়দানের পশ্চিমে একটি সুলম্বিত পুরাতন দিঘি। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে এই দিঘিতে এনে অত্যাচার করত বলে নাম হয়েছে জুলুমসাগর। হয়তো একদা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত উন্নতিকল্পে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা জুলুম করে এই দিঘি খনন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ভূমিখণ্ডের ওপর ছিল রাজাদের নির্মিত জুলুমসাগর প্রাসাদ। একসময় এই প্রাসাদ ছিল ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বাসভবন। ইংরেজ শাসনের প্রাথমিক যুগে এই এলাকাটির নাম ছিল সাহেবপাড়া। কারণ সে সময় শহরের যত শ্বেতাঙ্গ সাহেব ছিলেন তাদের বাড়ি ছিল দিঘিপাড়া এলাকায়। দিঘিটি ছিল ওই পাড়ার শোভাবর্ধনকারী একটি প্রাকৃতিক সম্পদ।
বর্তমানে দিনাজপুর সার্কিট হাউস-সংলগ্ন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের বিনোদন কেন্দ্র কৃষ্ণকলির নিচে এই সাগরের অবস্থান। প্রায় ৮৪৩ শতক আয়তনের সাগরটি দিনাজপুরের মানুষের প্রিয়। ‘জুলুমসাগর’ সন্ধ্যায় জমজমাট হয়ে ওঠে।