নতুন প্রজন্ম আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার হাতিয়ার। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তারা রাখছে অনন্য অবদান। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? নিজেকে নিয়ে কী ভাবনা? প্রতি-উত্তরে এসেছে নানা স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর বাস্তবতার কথা...
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মোল্লা
ফাহিমা সুলতানা রাতুয়া
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, সেশন ২০২২-২০২৩
প্রয়োজন প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সৎ থাকার মানসিকতা
জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশ, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করা এবং দেশের কল্যাণে অংশীদার হওয়ার বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে যেন আমরা বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে পারি, তার জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সৎপথে থাকার মানসিকতা। কারণ আমাদের দেশের দুর্নীতির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। পাশাপাশি প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ মানুষের সংখ্যাও সীমিত। এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় হলো- আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মেয়ে রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়ে এখনো উদাসীন। এই উদাসীনতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রত্যেকের সংস্কৃতির সম্মান দিতে চাই : আমি নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। আমি একজন গবেষক হতে চাই। গবেষক হয়ে মানুষের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে তা দূর করতে চাই। প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর আলাদা সংস্কৃতিকে কেন সম্মান দেওয়া উচিত তা মানুষকে জানাতে চাই।
আহনাফ তাহমিদ ফাইয়াজ
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, সেশন ২০২৩-২০২৪
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য
আমি সব সময় একটি দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। আমার দেশ কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া একটি শান্তিপূর্ণ জনপদ হিসেবে গড়ে উঠুক। তরুণদের মন খুলে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। দেশের চাকরির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিশাল ঘাটতি রয়েছে। যে কোনো মূল্যে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা উচিত। একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা সর্বস্তরের মানুষের জন্য অপরিহার্য। সরকার ও প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি সংস্থাকে এমনভাবে পরিচালনা করা উচিত যেন তাদের প্রতিটি কাজ জনসমক্ষে উন্মুক্ত হয়। তাদের দুর্নীতির প্রতি শূন্য-সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করা উচিত। প্রত্যেককে তাদের ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। জবাবদিহিতা এমন একটি জিনিস যা অল্প সময়ের মধ্যে দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে পারে। চাকরির পেছনে দৌড়ানোর পরিবর্তে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর লক্ষ্য হোক দক্ষতা অর্জন।
প্রযুক্তিনির্ভর জাতি গড়তে কাজ করব :
আমার গ্র্যাজুয়েশনের এখনো তিন বছর বাকি। কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে আমার লক্ষ্য স্পষ্ট- এমন একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করা যেখানে আমাদের জাতি প্রযুক্তির পূর্ণ ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে। আমাদের তাৎক্ষণিক মনোযোগ হওয়া উচিত আধুনিক সফটওয়্যার, ক্লাউড পরিকাঠামো এবং সুসংহত ডিজিটাল সরকারি পরিষেবাগুলোর ওপর জোর দেওয়া।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খুলনা ব্যুরো প্রধান সামছুজ্জামান শাহীন
আলকামা রমিন
শিক্ষার্থী, বাংলা অনুষদ
তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে
আমার প্রথম চাওয়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন বা চাকরি কোনো ক্ষেত্রেই বৈষম্য থাকবে না। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চাকরি দেওয়া হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও বৈষম্য দূর করতে হবে। বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ দেশ। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে তরুণরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। আইডিয়া জেনারেটের পেছনে তরুণদের ভূমিকা থাকবে। তাদের মূল্যায়ন করতে হবে।
দেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে চাই : আমার কর্মপরিকল্পনা এখনো কিছুটা অগোছালো। ১৯৪৭, ১৯৭১, ২০২৪ সবক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত তরুণরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। তাদের অনেকে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন। তাদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। আমার মনে হয়, যদি মিডিয়ায় সৎ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে পারি, কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ না খাটিয়ে সুন্দর একটা বাংলাদেশের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করব। দেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে চাই।
মো. মিরাজুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও সভ্যতা অনুষদ
রাষ্ট্রের কাঠামোতে যে বৈষম্য আছে, তা সংস্কার করতে হবে
আমি এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। বর্তমান সমাজে বা রাষ্ট্রের কাঠামোতে যে বৈষম্য আছে তা সংস্কার করতে হবে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ থাকবে না। বর্তমানে আইন-আদালত হয়ে গেছে ধনীদের জন্য। চাকরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে স্বজনপ্রীতি বা নেপোটিজম কথাটা সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
এর মাধ্যমে পরিবারতন্ত্র তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মেধার প্রাধান্য থাকা উচিত। বিভিন্ন কোটার বৈষম্য তৈরি করায় সাধারণ কৃষকের সন্তান ভালো মার্কস পেয়েও কাক্সিক্ষত সাবজেক্ট পায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। এ ধরনের বৈষম্য দেখতে চাই না। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চাই। শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। যাতে নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে।
উন্নয়নের সারথী হতে চাই : দেশের উন্নয়নে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার ও মানুষের বাক্স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে সংকট মোকাবিলায় অংশীদার হিসেবে নিজেকে দেখতে চাই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রুবেল হোসাইন
এ বি জব্বার
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ (৫০ ব্যাচ)
মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সরকার ও জনগণের মেলবন্ধন থাকা চাই
আমি এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই যা উন্নত, সমৃদ্ধ এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র। যেখানে শিক্ষা, গবেষণা ও মেধার যথার্থ মূল্যায়ন হবে। যেখানে দুর্নীতি বা অরাজকতা নয়, বরং শান্তি ও সুশাসন বিরাজ করে। বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। এ স্বপ্ন পূরণে সরকার ও জনগণ উভয়ের মেলবন্ধন থাকা চাই। সরকারের স্বদিচ্ছা ও জনগণের সহযোগিতাই পারে আগামীর স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে।
চিন্তাশীল প্রজন্ম গড়তে ও মানবিক মূল্যবোধের বীজ বপন করতে চাই : দর্শনচর্চার মাধ্যমে আমি একটি যৌক্তিক, নৈতিক সমালোচনামূলক চিন্তাশীল প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই। একটি কুসংকারমুক্ত, সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে চাই। দর্শনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তরুণদের মাঝে ক্রিটিক্যাল থিংকিং, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বীজ বপন করতে চাই। এর মাধ্যমেই আমি একটি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে চাই।
শ্রাবণী জামান জ্যোতি
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ (৫০ ব্যাচ)
আমাদের প্রত্যেকের ভুলগুলো সংশোধন হলে দেশ বদলে যাবে
আমি মনে করি, দেশের অর্ধেক মানুষও যদি সৎভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে ও নিজের ভুলগুলোর সংশোধন করে তাহলে এই দেশ বদলে যাবে। একজন সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থী হিসেবে আমার চাওয়া এমন একটি বাংলাদেশের যেখানে সব নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। প্রশাসনিক কাঠামো ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় আকারে সংস্কার দরকার। ডিসেন্ট্রালাইজেশন প্রয়োজন। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নারী হয়রানি, অনলাইন বুলিং হলে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সদিচ্ছা থাকলে যে কেউ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে : দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই থাকি, যে পেশাতেই থাকি দেশের জন্য আমি সাধ্যমতো কাজ করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, সদিচ্ছা থাকলে যে কেউ, যে কোনোভাবে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর সাইফুল ইসলাম
বিথিকা পাল
শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ , সেশন ২০২৩-২৪
বেকার নয়, কর্মসংস্থানের বাংলাদেশই লক্ষ্য
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজারো তরুণ-তরুণী স্বপ্ন বুকে নিয়ে বের হয় কর্মজীবনে প্রবেশের আশায়। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুল শিক্ষার্থী বের হলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না। কারণ চাকরির সুযোগ সীমিত, আর মেধার সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া। এর ফলে অনেকেই দেশের বাইরে পাড়ি জমায়। আবার কেউ কেউ হতাশায় পড়ে মেধাকে ব্যবহার করতে পারে না। এই সংকট দূর করা এখন সময়ের দাবি।
আগামীর বাংলাদেশকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রথমেই কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিল্পায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করা জরুরি। একই সঙ্গে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প, কৃষি, ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ বাড়লে তরুণরা নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারবে। পাশাপাশি শুধু সার্টিফিকেট নয়, বাস্তব দক্ষতাকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। দক্ষতার ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করলে তরুণদের মেধা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হবে।
নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই আমার লক্ষ্য : আমি শুধু চাকরি প্রার্থী নই বরং কর্মসংস্থানের স্রষ্টা হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি নিজেকে যুগোপযোগী দক্ষতায় গড়ে তুলতে চাই। উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা ও উদ্যোক্তা কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই আমার লক্ষ্য। আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যদি কয়েকজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পারে তবে সেটি হবে দেশের প্রতি আমার বড় অবদান। এভাবেই প্রতিটি তরুণ-তরুণী যদি দায়িত্ব নেয় তবে আগামীর বাংলাদেশ হবে বেকারত্ব মুক্ত ও মেধাবীদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ এক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র।
সামিউল আজিম
শিক্ষার্থী, আইপিই , সেশন ২০২১-২২
আত্মনির্ভর, মর্যাদাশীল জাতিসত্তা গড়তে চাই
‘কেমন বাংলাদেশ চাই?’- প্রশ্নটি এখন শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে রাজপথে এর উত্তর লিখে দিয়েছে। এটি শুধু একটি সরকারের পতন নয়, বরং এমন এক ব্যবস্থার পতন যেখানে রাষ্ট্র আর নাগরিকের সামাজিক চুক্তি বহু আগে ভেঙে গিয়েছিল। দশকের পর দশক মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছে, তাদের মতামত অগ্রাহ্য করা হয়েছে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কাগুজে উন্নয়নের ভেলকিবাজি আর বাছাই করা প্রবৃদ্ধি কিছু মানুষের হাতে অঢেল সম্পদ জমা করেছে, কিন্তু কোটি তরুণের জীবনকে ঠেলে দিয়েছে হতাশা ও অচলাবস্থায়। তাই বিস্ফোরণ আসাটাই ছিল অনিবার্য। রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াই তার আসল চরিত্র উন্মোচন করেছে, এটি জনগণের সেবক নয়, বরং ঔপনিবেশিক দমনযন্ত্রের উত্তরসূরি। এই অভ্যুত্থান ভুয়া উন্নয়ন বয়ানকে অস্বীকার করেছে, যা বৈষম্যকে ঢেকে রাখার হাতিয়ার ছিল।
তার বদলে জন্ম নিয়েছে এক নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশ। যেখানে মর্যাদা ভয়ের ঊর্ধ্বে, ন্যায়বিচার আর সমতা কাগুজে পরিসংখ্যানের চেয়ে বড়, আর সমাজের প্রান্তিক মানুষরাই জাতির অগ্রাধিকার। এ কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের আহ্বান নয়, এটি সাংস্কৃতিক মুক্তিরও ঘোষণা-ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে এক আত্মনির্ভর, মর্যাদাশীল জাতিসত্তা গড়ার দাবি। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান তাই ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তব রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই : একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। নিজের পড়াশোনা, গবেষণা ও ক্যারিয়ার এমনভাবে গড়তে চাই যেন দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারি।
সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে আগামী প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হতে চাই। নাগরিক হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও কার্যকরী অবদান রাখার চেষ্টা থাকবে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
তাসমিয়া মামুন মারিয়া
শিক্ষার্থী, এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদ
সবার জন্য চাই সমান সুযোগ
আমি চাই বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হোক যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। আমি চাই দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও দুর্নীতি কমে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে উন্নতি হোক। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ, উর্বর জমি ও পরিশ্রমী মানুষ আছে। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে রূপান্তর করা সম্ভব। আমি চাই প্রত্যেক নাগরিক শিক্ষিত হোক, যাতে তারা নিজের ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। শিল্প, কৃষি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি শক্তিশালী ও সম্মানিত দেশ হিসেবে গড়ে উঠুক। আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে শান্তি, ন্যায়, সমতা ও মানবতার দেশ।
শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে চাই না : আমি নিজেকে সৎ, পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস মানুষকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে আমি এমন একটি পেশায় থাকতে চাই যেখানে সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করতে পারি। আমি চাই ভবিষ্যতে আমাকে দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হোক এবং বলুক, ‘সে চেষ্টা করেছে, তাই সফল হয়েছে।’ আমি নিজেকে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না, বরং পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি তাসনিম আহমেদ তানিম
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোফাজ্জল হক
শিপ্রা রানী নাথ
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম আছে
রাজনীতি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানসহ প্রায় সব জায়গাতেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, তরুণ প্রজন্ম যদি নিজেদের দক্ষতা বাড়ায়, ইতিবাচকভাবে চিন্তা করে এবং সমাজে অবদান রাখে, তবে এসব চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তর করা সম্ভব। এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে। প্রযুক্তি, গবেষণা ও শিক্ষা খাত উন্নত হবে, তরুণরা দক্ষ হয়ে চাকরির পেছনে না ছুটে, চাকরি তাদের কাছে আসবে। সাধারণ মানুষ সমান অধিকার, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পাবে। গ্রামীণ এলাকাগুলো প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি স্বপ্ন দেখি এমন একটি সুন্দর বাংলাদেশ যেখানে সবাই সমান সুযোগসুবিধা ভোগ করবে এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে।
সমাজে ও অন্যদের জন্য ইতিবাচক অবদান রাখতে চাই : আমি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী এবং পরিশ্রমী মনে করি। নতুন ভাষা শিখছি এবং নেতৃত্ব ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের চেষ্টা করছি। আমি চাই আমার দক্ষতা ব্যবহার করে সমাজে ও অন্যদের জন্য ইতিবাচক অবদান রাখতে পারি। আমি একজন অ্যাকাডেমিক হতে চাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ করার লক্ষ্য রাখি। সমাজকর্মে স্নাতক শেষ করার পর আমি বিদেশে মাস্টার্স এবং পরবর্তীতে পিএইচডি করার পরিকল্পনা করেছি। পিএইচডি শেষ করার পর, আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে আমার ফিল্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চাই।
আমি নিজেকে একজন সফল একাডেমিক হিসেবে দেখতে চাই। আমি তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে আগ্রহী।
আশিকুর রহমান আশিক
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
বাংলাদেশ হোক মানবিক রাষ্ট্র
বাংলাদেশ ভূখণ্ড অদম্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী লড়াই- প্রতিটি আন্দোলনে তরুণরা এগিয়ে ছিল। ২০২৪-এর গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পতনের পর আমাদের বহুল আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনের সময় এসেছে। এই অভ্যুত্থান আবারও প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের আসল মালিক জনগণ। আগামীর বাংলাদেশ হবে ২৪-এর আকাক্সক্ষার নিরিখের বাংলাদেশ যেখানে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা থাকবে। জনগণের মতামত শোনা হবে প্রতিদিনের শাসন ব্যবস্থায়। সংসদ হবে বিতর্ক ও সমাধানের জায়গা আর বিচারব্যবস্থা হবে নিরপেক্ষ ও অটল। আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ। তরুণদের হাতেই আসুক ভবিষ্যতের রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব। আগামীর মানবিক ও কল্যাণমুখী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে আরও সৃজনশীল ও বাস্তবভিত্তিক, যা তরুণ প্রজন্মকে আত্মনির্ভর করবে। আগামীর বাংলাদেশ হোক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারমুক্ত। যেখানে যোগ্যতা হবে সবকিছুর মাপকাঠি। সবশেষে আমি চাই বাংলাদেশ হোক মানবিক দেশ। যেখানে মতের ভিন্নতা থাকলেও ভ্রাতৃত্ব থাকবে। রাষ্ট্র কেবল আইন দিয়ে নয়, ভালোবাসা ও ন্যায় দিয়ে চলবে।
আত্ম উন্নয়নের বিকল্প নেই : দেশের তরুণ প্রজন্মের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ। তাই আমাদের আত্ম উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে আত্ম উন্নয়নে সচেষ্ট থাকব।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিনাজপুর প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম
নুরনাহার খাতুন
শিক্ষার্থী, সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস, লেভেল-৪
জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকার স্বপ্ন দেখি
ভবিষ্যতের বাংলাদেশে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো সুরক্ষিত থাকবে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই ন্যায্যতা থাকবে। আমরা এমন একটি দেশের নাগরিক, যাদের পূর্বপুরুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। আমাদের হাতে এখন এ দেশ গড়ার দায়িত্ব। আমি চাই শিক্ষিত বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি ছেলেমেয়ে সমানভাবে মানসম্মত শিক্ষা পাবে। আমি চাই, একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ যেখানে প্রতিটি কাজ হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে।
আমি চাই একটি প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ, যেখানে আমরা শুধু ভোক্তা নই, বরং উদ্ভাবক হব। আমি চাই একটি মানবিক বাংলাদেশ, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে সবাই শান্তিতে ও সহমর্মিতায় বসবাস করবে। এর জন্য আমাদের সবার আগে প্রয়োজন আমাদের নিজেদের পরিবর্তন করা, আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত উন্নয়নে কাজ করতে চাই : আমি একজন দেশপ্রেমী, সমাজপ্রেমী এবং পরিবেশপ্রেমী মানুষ হিসেবে দেশ এবং দেশের মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করতে চাই। আমি একজন সৎ ও শিক্ষিত মানুষ হতে চাই। যে মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে, দুর্নীতিতে রুখে দাঁড়ায়। আমি মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত উন্নয়নে কাজ করতে চাই। দেশ মানে শুধু মাটি নয়, এ দেশের মানুষও। আমি চাই সবার অংশগ্রহণে বাসযোগ্য, সমৃদ্ধ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে।
কামরুল হাসান রাব্বি
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ২০২১ শিক্ষাবর্ষ, লেভেল-৪
দুর্নীতিমুক্ত, জনবান্ধব প্রশাসনই স্থায়ী উন্নয়নের ভিত গড়ে দেবে
আমি চাই আমার দেশ হোক একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণ দেশ। যেখানে জনগণ তাদের অধিকার নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে সাধারণভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে। রাজনীতি হলো মানবসেবার এক মহান পেশা। আমি চাই এমন একটি রাজনৈতিক জ্ঞানচর্চা যা মানুষকে অন্ধকার দূরীভূত করে আলোর পথ দেখাবে, যা মানুষকে নৈতিক, ন্যায়পরায়ণ, মহানুভবতা ও উদারতার শিক্ষা দেবে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নয়, পরোপকারই হবে রাজনীতির মূল আদর্শ। আমি চাই সরকারি চাকরি, শিক্ষা বা প্রশাসন সেক্টরে দুর্নীতি দূর হোক কেউ এমনভাবে বলুক, আজ আমি এই কাজটা কোনো ঘুষ ছাড়াই করে ফেলেছি। ‘টাকা ছাড়া চাকরি হয় না’, এই কথার বিপরীতে এ কথা আসুক, ‘এখন আর টাকা দিয়ে চাকরি হয় না পড়াশোনা করতে হয়’। আমি চাই, দেশের নাগরিকরা শিক্ষিত ও দক্ষ হোক, নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সঙ্গে দ্রুত পরিচিত হোক এবং সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন স্কিল-বেসড ট্রেনিং প্রদান করা হবে, যা ভবিষ্যতের চাকরির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীরাও সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে যার নিজ নিজ জায়গা থেকে দক্ষ, স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হোক। আমার বিশ্বাস একটি দুর্নীতিমুক্ত, শিক্ষিত, দক্ষ, সচেতন ও জনবান্ধব প্রশাসনই তৈরি করতে পারে দেশের স্থায়ী উন্নয়নের ভিত্তি।
বহুমুখী জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট থাকব : নিজেকে ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতে যুক্ত দায়িত্বশীল ও নীতিবান কর্মী হিসেবে দেখতে চাই, যেখানে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারব। আমি চাই নিজেকে সব সময় নতুন স্কিল ও জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত রাখতে। কোনো কাজ পুরোপুরি আয়ত্ত করতে না পারলেও অন্তত তার মৌলিক ধারণা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করাকে আমি জরুরি মনে করি। কারণ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বহুমুখী জ্ঞান থাকা জরুরি।