চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন দিঘি ‘আসকার দিঘি’। একসময় এটি ছিল নয়নাভিরাম। কিন্তু এখন দিঘিটি দখল হচ্ছে। প্রতিদিনই একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে এ দিঘি। তৈরি হচ্ছে স্থাপনা। এটির অনতিদূরেই আছে শতবর্ষী প্রাচীন রানির দিঘি। এ দিঘিটিরও অভিন্ন দৃশ্য। প্রতিনিয়তই হচ্ছে ভরাট, দূষণ। এভাবে চট্টগ্রামের শতবর্ষী প্রাচীন দিঘিগুলো ক্রমে ভরাট ও দখলের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত। স্থানীয় প্রভাবশালী ও দখলদারদের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক দিঘিগুলো। বিলীন হচ্ছে মোগল আমলে এ জনপদে খনন হওয়া দিঘি-পুকুর। চট্টগ্রামে গত ৪০ বছরে ২৪ হাজারের মতো পুকুর-দিঘি ভরাট হয়েছে। এর মধ্যে আছে অনেক ঐতিহ্যবাহী দিঘি, পুকুর, জলাশয়। দখল, দূষণ ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে দিঘিগুলো। দিঘির চারদিকে উঠছে বহুতল স্থাপনা। বেদখলে সংকুচিত হচ্ছে। চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধির ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি, বংশ ও এলাকার নামে ৩৭৬টি দিঘি খনন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে এসব দিঘির অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, আসকার দিঘি ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি মোগলরা আরাকানদের পরাজিত করে চাটিগাঁ দুর্গ দখল করেন। মোগলদের অনেক ফৌজদার ছিল। মোগলদের দ্বিতীয় ফৌজদার হলেন আসকর খাঁ। আসকর খাঁর আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ বেগ। আর পূর্ণ নাম ছিল নবাব আসকর খাঁ বজমে সানি। ১৬৬৯-১৬৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর তিনি চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। মোগল শাসনামলে এই দুর্গে ১০ হাজার সৈন্য থাকত। সৈন্যদের জন্য পানি সরবরাহের সুবিধার্থে নবাব আসকর খাঁ এই দিঘি খনন করান। জনশ্রুতি ছিল, পরীর পাহাড় (কোর্ট হিল) থেকে পরীরা এই দিঘির স্বচ্ছ পানিতে স্নান করতে আসত। কিন্তু বর্তমানে আসকার দিঘিকে আর দিঘির মতো মনে হবে না। চারদিকে কচুরিপানায় পূর্ণ। পানির পরিমাণ খুবই কম। নিয়মিত ফেলা হয় পলিথিন, পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি ও নানা আবর্জনা। ক্রমেই ছোট হচ্ছে দিঘির আয়তন। হারাচ্ছে সৌন্দর্য। অন্যদিকে, নগরের বলুয়ার দিঘিটিও ২০০ বছরের পুরোনো। এটিও দখল-দূষণের শিকার। কাগজে দিঘির আয়তন সাড়ে ছয় খানির কথা বলা হলেও বাস্তবে অর্ধেকও নেই। দিঘির জায়গা দখল করে হয়েছে বহুতল ভবন-বাণিজ্যিক স্থাপনা। এই দিঘির পাশেই আছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, টেরিবাজারসহ দেশের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক মার্কেট। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ দিঘি আশীর্বাদ হলেও এখন তার সুফল মিলে না। তা ছাড়া, রানির দিঘি নগরের একটি ঐতিহ্যবাহী দিঘি। এ দিঘির সঙ্গে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এটিও দখল-দূষণে ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। জলাশয় বাঁচাও আন্দোলনের উদ্যোক্তা অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেন, এখন প্রাকৃতিক দিঘিগুলো বাঁচাতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন দরকার। দিঘি, জলাশয় ও পুকুর রক্ষা এবং তা ফিরিয়ে আনতে সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া, দিঘিগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। পরিকল্পিত ফোরাম চট্টগ্রামের যুগ্ম সম্পাদক তাসলিমা মুন বলেন, ১৯৬১, ১৯৯৫ এবং ২০২০ সালের নগর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনায় দিঘি রক্ষার কথা বলা আছে। কোনো মতেই দিঘি ভরাট-দখল-দূষণ করা যাবে না। নির্মাণ করা যাবে না স্থাপনা। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের শতবর্ষী প্রাচীন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ও ঐতিহ্যবাহী উল্লেখযোগ্য দিঘিগুলোর মধ্যে আছে, আসকার দিঘি, রানির দিঘি, বলুয়ার দিঘি, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি, কাট্টলীর মালকা বানুর দিঘি, উত্তর কাট্টলির চৌধুরী দিঘি, দক্ষিণ হালিশহরের হামজার দিঘি, খাজার দিঘি, মধ্যম হালিশহরের কলসির দিঘি, হাজি কাশেমের দিঘি, বদর শাহ্ মাজারের পাশ সংলগ্ন পুকুর, বায়েজিদ বোস্তামির দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, আগ্রাবাদের দাম্মো দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারির দিঘি, কাজীর দিঘি, উত্তর আগ্রাবাদ মুহুরী পাড়ার ময়লা পুকুর, কাট্টলীর পদ্মপুকুর দিঘি, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, হামজারবাগের হামজা খাঁ দিঘি। উপজেলার মধ্যে আছে, মিরসরাই থানার পরাগলপুরের ছুটি খাঁ দিঘি, হাটহাজারীর ফতেয়াবাদের নসরত শাহর ঘি, আলাওলের দিঘি, ফতেয়াবাদ ক্ষেত্রপাল বাড়ির শতবর্ষী পুকুর।