ম্যানশন আকৃতির আলিশান বাড়ির সামনে ড্রাইভওয়েতে হাল মডেলের দামি গাড়ি আর পেছনে নোঙর করা ব্যক্তিগত স্পিডবোট। বাড়ির পেছন দিয়ে বের হয়েই ব্যক্তিগত বোটে লেকে ঘুরে আসা যায়। কিংবা ড্রাইভওয়েতে পার্ক করে রাখা অতি দামি গাড়ি নিয়ে শাঁইশাঁই করে ছুটে যাওয়া যায় যে কোনো দিকে। এমন দৃশ্যের বর্ণনা দিলে যে কেউ এটিকে কোনো সিনেমার দৃশ্য হিসেবেই বিবেচনা করবেন।
টরন্টো থেকে গার্ডিনার এক্সপ্রেস ধরে মাত্র ৪০ কিলোমিটারের দূরত্বে এমন সিনেমাটিক জীবনযাপন করছেন বেশ কিছু বাংলাদেশি। না, তাঁরা যে কানাডায় অনেক বছর ধরে আছেন, তুমুল জীবনসংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে কিংবা ব্যবসাবাণিজ্য করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারা নয়। তাঁদের অধিকাংশই কানাডায় এসেছেন গত কয়েক বছরে এবং বাড়িগুলো কেনা হয়েছে এ সময়েই। কানাডায় তাঁদের দৃশ্যমান তেমন আয়ের কোনো উৎস নেই। তাঁদের অধিকাংশই বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন বিভাগের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা। কানাডার বেগমপাড়ার চেয়েও নতুন কিছু নাম টরন্টোর বাংলাদেশিদের আড্ডায় এখন উচ্চারিত হয়। বিশেষ কয়েকটি পেশা বা বিভাগের নামে পল্লি বা পাড়া যুক্ত হয়ে নতুন উপমাগুলো বেগমপাড়াকেও ম্লান করে দিচ্ছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা কানাডায় এসেছে, তা এক রেকর্ড। এমন কথা এখন টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়।
বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সেগুলো ফেরত না দিয়ে কানাডায় পাচার করে আয়েশি জীবনযাপন করা বাংলাদেশিদের ব্যাপারে অন্তর্র্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় আসা লোকের সংখ্যা কতজন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। বাংলাদেশ থেকে আসা সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ী বা রাজনীতিকমাত্রই যে অর্থ পাচারকারী, তা নয়। কিন্তু সরকারের যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে চাকরিতে থাকা কেউ যদি টরন্টোর প্রাণকেন্দ্রে দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার নগদ মূল্যে আলিশান বাড়ি কিনে ফেলেন, তখন তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখার যথেষ্ট কারণ থাকে। এটা সত্য, উত্তর আমেরিকায় ক্রেডিট স্কোর ভালো থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনা যায়। কিন্তু সে জন্য নির্দিষ্ট আয় থাকতে হয়। কানাডায় যাঁদের দৃশ্যমান কোনো আয় নেই, এমন কেউ নগদ ডলারে আলিশান বাড়ি কিনলে তাঁদের নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।
কানাডার ফেডারেল সংস্থা ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের তথ্য দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দিয়েছে। এরপর টরন্টোয় লুটেরাবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সময় বিশ্বব্যাপী মুদ্রা পাচার নিয়ে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সঙ্গে জড়িত কানাডীয় কয়েকজন সাংবাদিক অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে সন্দেহভাজন মুদ্রা পাচারকারী ২০০ বাংলাদেশির একটি তালিকা আছে। তালিকা ধরে তাঁরা তথ্যগুলো যাচাইবাছাই করার কাজ করছেন। এদিকে কানাডায় সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেন দেখভালের দায়িত্বে থাকা ফেডারেল সংস্থা ফিনট্র্যাক (দ্য ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার অব কানাডা) মুদ্রা পাচারের ১ হাজার ৫৮২টি ঘটনা চিহ্নিত করেছে। চিহ্নিত মুদ্রা পাচারকারীদের বিস্তারিত তথ্য কানাডীয় সিকিউরিটিজ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং আরসিএমপির কাছে হস্তান্তর করে। এরপর থেকে কানাডা সরকার বাংলাদেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। কানাডা বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রেও অধিকতর যাচাইবাছাই করা শুরু করেছে। কানাডায় সম্পদ কেনার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। দুই শত বাংলাদেশির মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ব্যাংকার নাফিজ সরাফত, আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফরউল্লাহ, শহীদ ইসলাম পাপুল, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদ। সাবেক স্বাস্থ্য সচিব মনজুরুল ইসলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান। পি কে হালদার, সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার হালদার, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সোবাহান গোলাপসহ অনেকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই তালিকায় কানাডায় বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্যের নাম নেই। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, তার সব সম্পদের অর্থ এসেছে তৃতীয় দেশ থেকে। কানাডায় সেই দেশের কোম্পানির শাখা করে অর্থ নেওয়া হয়েছে বৈধভাবে। যে কারণে এটিকে কানাডা বৈধ অর্থ হিসেবে বিবেচনা করে।
জানা গেছে, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, শেয়ারবাজারের ব্রোকার, রিয়েল এস্টেট ব্রোকারেজ এবং ক্যাসিনো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ফেডারেল সংস্থাটি অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ঘটনা উদঘাটন করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, কভিডের মধ্যেও বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে কানাডায় আসে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ফিনট্র্যাক বাড়তি তদন্ত শুরু করে। রিয়েল এস্টেট ব্রোকারেজগুলোয় গোয়েন্দাদের বাড়তি নজর দেওয়া হয়। কভিডে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই কানাডার অর্থনীতি প্রবল চাপের মধ্যে থাকলেও রিয়েল এস্টেট বাজার যথেষ্ট চাঙা ছিল। টারানেট-ন্যাশনাল ব্যাংকের ইনডেক্সের তথ্য অনুসারে, পুরো কানাডায় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে বাড়ির দাম ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাড়ির দাম পর্যবেক্ষণের তথ্যের জন্য এই ইনডেক্সকেই গ্রহণযোগ্য সূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থনীতি চাপে থাকা সত্ত্বেও বাড়ি বাজার এত চাঙা হলো কীভাবে? সেই দুঃসহ সময়ে কারা কিনছেন এই বাড়ি? এ নিয়ে নানা ধরনের মুখরোচক গল্প চালু আছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। কোন সরকারি কর্মকর্তা কোথায় আড়াই মিলিয়ন ডলার (২৫ লাখ ডলার বা প্রায় ২২ কোটি টাকা) নগদ দিয়ে বাড়ি কিনলেন, কোন রাজনীতিকের মেয়ের জামাই আলিশান বাড়ি কিনেছেন, কোন টেলিভিশনের পরিচালক নিজের পছন্দ করা নকশায় দৃষ্টিনন্দন বাড়ি বানাচ্ছেন নগদ অর্থে, এসব নিয়েও তুমুল আলোচনা হয়।