সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, সংস্কার হয়েছে, কিন্তু বৈষম্য আরও বেড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে এখনো একটি টেকসই ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর মতে, ‘স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনো এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে পারিনি, যা জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। ফলে এখন দেশের লক্ষ্য সীমিত, একটি জবাবদিহিমূলক ও টেকসই গণতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ ঘটানো।’ গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড সি এঙ্গারম্যানের লেখা বই ‘অ্যাপোসলস অব ডেভেলপমেন্ট : সিক্স ইকোনমিস্টস অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড দে মেড’। বইটিতে দক্ষিণ এশিয়ার ছয় প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদের চিন্তাধারা তুলে ধরা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক হয়। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী সংসদ এবং কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে না পারলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বাজারব্যবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়, তবে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে এই বাজারব্যবস্থা ন্যায্যতা ও সামাজিক সমতা রক্ষা করে।’ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে আদর্শিক বিভাজন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। কে ডান, কে বাম-এই পার্থক্য এখন প্রায় বিলীন। রাজনীতিতে ধর্মীয়, সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক নানা মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এখন জনগণ এমন একটি সমাজ চায়, যেখানে বৈষম্য কমবে, মানুষ মর্যাদা পাবে এবং রাষ্ট্র সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে।’ সেমিনারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও আমরা বৈষম্য কমানোর প্রকৃত উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। বিগত ১৭ বছরে সংস্কার হলেও আয় ও সম্পদের বৈষম্য আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি, দারিদ্র্য কমেছে, কিন্তু একই সঙ্গে সমাজে বৈষম্য ভয়াবহভাবে বেড়েছে। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়- এটি রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। এখন সমাজের আর্থিক অভিজাতরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে, ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।’
রেহমান সোবহান আরও বলেন, ‘বর্তমান নীতিনির্ধারকরা বৈষম্যকে কেবল দারিদ্র্যবিমোচন বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছেন। কিন্তু মূল কাঠামোগত কারণ, যেমন-সম্পদে অসম প্রবেশাধিকার, রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ সীমিত থাকা- এসব বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য রাষ্ট্রীয় কারণেই তৈরি হয়েছিল, বাজারব্যবস্থার কারণে নয়। তাই স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এত বছর পরও আমরা সেই বৈষম্য দূর করতে পারিনি।’ উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার ছয়জন অর্থনীতিবিদের মধ্যে বাংলাদেশের রেহমান সোবহান, পাকিস্তানের মাহবুব উল হক, শ্রীলঙ্কার লাল জয়বর্ধনে, ভারতের অমর্ত্য সেন, জগদীশ ভাগবতী ও মনমোহন সিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন তত্ত্বে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছেন। এ বিষয়ে ‘অ্যাপোসলস অব ডেভেলপমেন্ট : সিক্স ইকোনমিস্টস অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড দে মেড’ শীর্ষক বই লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক ডেভিড সি এঙ্গারম্যান। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ এবং বইটির লেখক ডেভিড সি এঙ্গারম্যান। উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মোস্তাফিজুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক অধ্যাপক এ কে এনামুল হক।