ঢাকাই চলচ্চিত্রে বর্তমান সময়ে নতুন নায়ক-নায়িকার কোনো অভাব নেই। অভাব রয়েছে তাদের কাজের। নির্মাতাদের কাছে তারা উপেক্ষিত। কিন্তু কেন? এ বিষয়ে কয়েকজন তরুণ নির্মাতার বক্তব্য তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
নতুনদের নিয়ে চর্চা করতে হবে : সাইফ চন্দন
আমি আমার প্রায় সব ছবিতেই নতুনদের নিয়ে কাজ করেছি। পুরাতন বা সুপারস্টারদের নিয়ে কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। সুপারস্টারদের মেনটেইন করতে হয়, সে সময় আমার নেই। একজন সুপারস্টার বা পুরনো শিল্পী নিয়ে কাজ করতে গেলে তার অসহযোগিতার জন্য সময়মতো কাজটি শেষ করা সম্ভব হয় না। নতুনদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। আমি মনে করি, যে শিল্পী মনে প্রাণে বলবে এটি আমার ছবি এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে তাকে নিয়েই নিশ্চিন্তে কাজ করা যায়। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে একটি বাজে প্রথা চালু আছে, যেমন বলা হয়- সুপারস্টার তকমার মার্কেট ভ্যালু আছে। একজন সুপারস্টার ছবিতে না থাকলে সে ছবি টিভি রাইটস, ওটিটি এবং সিনেমা হল মালিকরা নিতে চায় না। নিলেও রেট থাকে খুবই কম। এ কারণে নতুনরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থেকে যায়। আমি বলব, নতুনদের যদি প্রপারলি ব্যবহার করা যায় তাহলে সে আর নতুন থাকে না। ‘ডিরেক্টর নয়, সুপারস্টার ছবিতে আছে কিনা?’ এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। প্রপার কন্টেন্ট ও ক্যারেক্টর দিয়ে নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। প্রোডাকশন হাউসগুলো নতুনদের নিয়ে গবেষণা করে না। যেহেতু আমাদের দেশে নতুন শিল্পী তৈরির ক্ষেত্রে স্কুলিং ব্যবস্থা নেই, তাই তাদের নিয়ে চর্চা করতে হবে। কেননা চলচ্চিত্র হচ্ছে চর্চার জায়গা।
নতুনদের হাতে এখন অনেক মাধ্যম : মোস্তাফিজুর রহমান মানিক
চলচ্চিত্রে নতুনরা সুযোগ পাচ্ছে না, কারণ প্রযোজক, সিনেমা হল মালিক, ওটিটি, টিভি রাইটস সবাই সিকিউরিটি চায়। তাদের কথা হলো সুপারস্টার বা পুরনো শিল্পী হলে সিকিউরিটি থাকে। নতুনদের ক্ষেত্রে নয়। তাই পরিচালকের ইচ্ছা থাকলেও এ কারণে নতুনদের তারা নিতে পারেন না। আরেকদিকে এখনকার নতুনদের মধ্যে কাজ শিখে আসা ও প্রপারলি কাজ করার আগ্রহের অভাব আছে। কারণ তাদের হাতে এখন অনেক মাধ্যম রয়েছে। যেমন টিকটক, ইউটিউব, নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল, ওটিট ইত্যাদি। তাই আগের মতো বর্তমান সময়ের শিল্পীরা শুধু চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দেয় না। এ কারণে নতুনদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নির্মাতাদের বেগ পেতে হয়। নতুন শিল্পীদের মধ্যে কাজের আগ্রহ কম থাকায় তাদের কাজ হয় দুর্বল এবং দর্শক তাদের প্রত্যাখ্যান করে।
সবাই ফেসভ্যালু চায় : সৈকত নাসির
আমার প্রায় সব ছবিই নতুনদের নিয়ে নির্মিত। চলচ্চিত্রে নতুনদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে যেসব অন্তরায় রয়েছে সেগুলো হলো- সিনেমা হল মালিক, পরিবেশক, টিভি রাইটস, ওটিটির অনাগ্রহ। তারা ফেসভ্যালু নেই এমন নতুন শিল্পীর কাজ নিতে চায় না। যেমন পুরনো শিল্পীর কন্টেন্টের মূল্য যদি ওটিটি ৩০ লাখ টাকা দেয় সেখানে নতুন শিল্পী হলে ৫ লাখও দিতে চায় না। আসলে এক সময় দেখার এতো মাধ্যম ছিল না। একমাত্র সিনেমা হলই ছিল বিনোদনের মাধ্যম। তাই নতুন বা পুরনো যে শিল্পীর ছবিই হোক না কেন, দর্শক তা দেখতে বাধ্য ছিল। এখন দেখার মাধ্যম বেড়েছে বলে পছন্দের নতুন নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। আগে নির্মাতাদের ওপর সিনেমা হল মালিকদেরও আস্থা ছিল, নির্মাতারা যে শিল্পী নিয়েই কাজ করুক না কেন, তা তারা গ্রহণ করত। তা ছাড়া এখন কেউ আর কন্টেন্ট বিচার করে না, সবাই ফেসভ্যালু চায়। আরেকটি বিষয় হল পুরনো শিল্পীরা কাজের ক্ষেত্রে খুব পেইন দেয়; অন্যদিকে নতুনদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করা যায়। তাই নতুনদের থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারলে এই নতুনরা আর নতুন থাকবে না।
নতুনদের কাজের আগ্রহ কম : অনন্য মামুন
নতুন নায়ক নায়িকাদের নিয়ে কাজ করতে গেলে কাজ শুরুর কদিন পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের মধ্যে কাজের চেয়ে সহজে অর্থবিত্তের মালিক আর নাম করার অযৌক্তিক প্রবণতা থাকে। এ ক্ষেত্রে আমি নিজেও ভুক্তভোগী। ক’বছর আগে নতুন নায়ক-নায়িকা নিয়ে ‘কাছে এসে ভালোবাসো’ শিরোনামের একটি ছবি নির্মাণ শুরু করেছিলাম। কিন্তু তাদের অসহযোগিতায় কাজটি আজও শেষ করতে পারিনি। এ ছাড়া নতুনদের কন্টেন্ট সিনেমা হল মালিক, দর্শক, ওটিটি এবং টিভি নিতে চায় না। ফলে নির্মাতারা নতুনদের নিয়ে কাজ করতে ভরসা পায় না।
নতুনদের নিজস্ব রং থাকে না : রফিক শিকদার
আমি সবসময় নতুন নায়ক নায়িকা নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সিনিয়র নির্মাতারা পুরনো প্রথায় হাঁটে। তারা পুরনোদের নিয়েই কাজ করে। তাদের মতে নতুনদের নিয়ে কাজ করলে সেই কন্টেন্ট ব্যবসা করবে না।
একজন পরিচালকের দায়িত্ব হলো শিল্পী তৈরি করা। তিনি যদি নতুনদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারেন তাহলে নতুনরা সহজেই সবার দৃষ্টি কাড়বে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো কলকাতার মেয়ে ইধিকা পাল।
প্রিয়তমা ছবিতে নির্মাতা এই নতুন মেয়েটির কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে পেরেছেন বলে সে সহজেই তারকা হয়ে গেছে। শিল্পীদের আলাদা কোনো রং থাকে না।
নতুন শিল্পীকে প্রতিষ্ঠা করার মূল রং-ঢং এবং দায়িত্ব একমাত্র নির্মাতার।