ভাষার শক্তি অনেক আগেই কাঁটাতারের বেড়া ছিঁড়েছে দুই বাংলায়। সাহিত্য আর সংস্কৃতির মেলবন্ধনে দুই বাংলার বন্ধুত্ব এগিয়েছে দৃঢ় বাহুতে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর পরই সূচিত হয় দুই বাংলায় যৌথ প্রযোজনার নির্মাণ। ১৯৭৩ সালে যৌথ প্রযোজনায় আলমগীর কবির প্রথম নির্মাণ করেন 'ধীরে বহে মেঘনা'। তারপর এই আয়োজনে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস হয়ে উঠে সমৃদ্ধ। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, এক বাংলার শিল্পী অভিনয় করেছেন অপর বাংলার চলচ্চিত্রে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
বর্তর্মানে এপার বাংলার ছবিতে বাড়ছে ওপার বাংলার শিল্পীদের পদচারণা। যদিও এখানকার ছবিতে টালিগঞ্জ বা বলিউড তারকাদের অভিনয় নতুন কিছু নয়, তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে ওপার বাংলার শিল্পীদের এখানে কাজের আগ্রহ চোখে পড়ার মতো বাড়ছে। বর্তমানে কম করে হলেও টলিউডের ছয় তারকা কাজ করছেন বা করতে যাচ্ছেন ঢালিউডের ছবিতে। তারা হলেন- পাওলি দাম, পরমব্রত, সোহম, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, হিরণ ও হৃতিকা।
২০১৩ সালে কলকাতার অঙ্কুশ আর শুভশ্রী অভিনয় করেছেন ঢাকার নির্মাতা অনন্য মামুনের 'আমি শুধু চেয়েছি তোমায়' ছবিতে। এটি অবশ্য যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়। এরপর অঙ্কুশ ফের কাজ করেন 'রোমিও বনাম জুলিয়েট' ছবিতে। এটিও যৌথ আয়োজনে নির্মিত। ইন্দ্রনীল কাজ করেন এখানকার 'চোরাবালি' ছবিতে। চলতি বছর কলকাতার ওম অভিনয় করেন ঢাকার ছবি 'অগি্ন টু'-তে।
পাওলি দাম গত বছর কাজ শুরু করেন হাসিবুর রেজা কল্লোলের 'সত্তা' ছবিতে। এতে তার বিপরীতে আছেন ঢালিউডের শীর্ষনায়ক শাকিব খান। এ ছবির শুটিং এখনো শেষ হয়নি। আগামী মাসে শুটিংয়ে অংশ নিতে আবারও ঢাকা আসছেন পাওলি। এই অভিনেত্রী এখানকার চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতে যে আগ্রহী এখানে এসে সেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি। তার কথায় আমরা আশা আর ভাষায় এক হতে পারলে চলচ্চিত্রে কেন নয়?
গত বছরের ২৬ আগস্ট আসেন নায়ক হিরণ ও নায়িকা হৃতিকা। তারা কাজ করেন অনন্য মামুনের 'মন দিওয়ানা' ছবিতে। ছবির কাজ এখনো শেষ হয়নি। তাই চলতি বছর আবার ঢাকায় শুটিংয়ে অংশ নেবেন তারা। হিরণ বলেন, ঢাকার ছবিতে কাজ করতে পেরে ভালো লাগছে। কারণ ভাষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে দুই বাংলার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছি না।
২২ এপ্রিল ঢাকা আসেন টালিগঞ্জের নায়ক পরমব্রত। তিনি কাজ করেন অনিমেষ আইচের 'ভয়ংকর সুন্দর' ছবিতে। প্রায় টানা ২০ দিন এখানে এ ছবির শুটিংয়ে অংশ নেন তিনি। পরমব্রত কাজ করতে গিয়ে অনেকটা খুশিতে আত্দহারা হয়ে উঠেন। বলেন আরে এ যে দেখছি আমারই দেশ। ভাষা আর চিন্তায় কোনো অমিল নেই। তাহলে আমাদের মাঝে কেন বাধা হয়ে থাকবে কাঁটাতারের বেড়া। আমি এখানে নিয়মিত অভিনয় করতে চাই।
৫ জুন আসেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ৬ জুন থেকে তিনি অভিনয় করেন মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের 'সম্রাট' ছবিতে। এতে তার দুই সহশিল্পী হচ্ছেন শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস। ঢাকায় একটানা পাঁচদিন কাজ করেন তিনি। এই নায়ক অবশ্য এর আগে ঢাকার চলচ্চিত্র রেদোয়ান রনি পরিচালিত 'চোরাবালি'তে কাজ করেন। তার কথায় এখানকার মানুষ বড় আন্তরিক। তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। আমার ইচ্ছে এখানকার চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করে যাওয়ার।
১৩ জুন ঢাকায় আসেন টালিগঞ্জের বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় নায়ক 'বোঝেনা সে বোঝেনা' ছবি খ্যাত সোহম। স্থানীয় ছবি 'রকেট'-এ কাজ করবেন তিনি। এতে তার নায়িকা থাকছেন ঢাকার মীম। ছবির মহরতে যোগ দিতে ওইদিন ঢাকা আসেন সোহম। এখানকার ছবিতে বেশি করে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। তার কথায় আমার কাছে এখানকার চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী বেশ উন্নত মনে হয়েছে। আমার ইচ্ছে ছিল ঢাকার ছবিতে কাজ করার। সেই ইচ্ছে এখন পূরণ হলো। সুযোগ পেলে এখানকার ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করে যেতে চাই। সোহমের কথায় এটিই পরিষ্কার হয়ে গেল তিনিও এদেশ আর এখানকার চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়ে গেছেন। মানে তার প্রত্যাশা ঢাকার চলচ্চিত্রের একজন হবেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, কলকাতার চলচ্চিত্র তারকারা বর্তমানে ঢাকার ছবিতে কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বেশি। এর কারণ হিসেবে সূত্রটি উল্লেখ করে সত্তর দশক থেকেই বাংলাদেশের ছবি বিশেষ করে যৌথ আয়োজনের নির্মাণে ভারতের অনেক বড় মাপের শিল্পী কাজ করেছেন এবং বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তারা। এসব শিল্পীর মধ্যে সন্ধ্যা রায়, উৎপল দত্ত, রজেশ খান্না, ভিক্টর ব্যানার্জি, শাবানা আজমী, মিঠুন চক্রবর্তী, চাঙ্কী পান্ডে, সানি দেওল, জয়া বচ্চন, জয়াপ্রদা, শশী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর, রাজ বাব্বর, পারভীন বাবি, প্রসেনজিৎ, শতাব্দী রায়, ঋতুপর্ণা, রঞ্জিত মলি্লক উল্লেখযোগ্য। খ্যাতিমান এসব শিল্পীর পথ ধরে কলকাতার বর্তমান সময়ের অনেক শিল্পী এখন ঢাকার ছবিতে কাজের আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলেও জানায় সূত্রটি। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন, দুই বাংলার শিল্পীরা একে অপরের দেশের ছবিতে কাজ করলে সুফলটাই বেশি হবে। আর এ বিষয়টি যেহেতু নতুন কিছু নয়, তাই সুফলের ব্যাপারটা আগেই পরীক্ষিত হয়ে আছে। তবে শুধু অভিনয় নয়, দুদেশেই চলতে হবে এসব ছবি। তাহলে সংস্কৃতির বিনিময় আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও জোরালো হবে নিঃসন্দেহে। চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কথায় কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করে আমাদের খ্যাতিমান অভিনেত্রী ববিতা আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন। এমন আরও সফলতার উদাহরণ দুদেশের ক্ষেত্রেই রয়েছে। এখন যদি দুদেশের মধ্যে সত্যিকার অর্থে সমতা ও সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে এক বাংলার শিল্পী অপর বাংলায় অভিনয় এবং দুদেশের মধ্যে যৌথ আয়োজনে ছবি নির্মাণ বৃদ্ধি পায় তাহলে উভয় দেশের চলচ্চিত্র শিল্পই লাভবান হবে।
চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, টালিগঞ্জের শিল্পীরা সব সময়ই আমাদের দেশে কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু নানা কারণে তাদের নিয়ে কাজ করা হয়ে উঠে না। এর মধ্যে সরকারি অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি প্রধান। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা চলচ্চিত্রকাররা সম্মিলিতভাবে দূর করার পথ খুঁজে বের করলে সবাই লাভবান হব। আমাদের শিল্পী নায়করাজ রাজ্জাক থেকে শুরু করে ফেরদৌস পর্যন্ত টালিগঞ্জে কাজ করেছেন এবং করছেন। বন্ধু দেশের খাতিরে হলেও চলচ্চিত্রের মেলবন্ধনের ধারাকে এগিয়ে নেওয়া দরকার বলে মনে করেন চলচ্চিত্রকার ও দর্শকরা। বিশেষ করে বাংলা ছবির বাজার বড় করতে দুই দেশের এক হতে হবে বলেই মত সবার।