হাঁটু ও হাতের এক্সরে করাতে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হয় কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। বেলা সাড়ে ১১টায় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। প্রথমে তাঁকে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের ৫১২ নম্বর কক্ষে রক্ত পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়। এরপর তাঁর হাঁটু ও হাতের এক্সরে করাতে নেওয়া হয় রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা মেডিকেল চেকআপ শেষে দুপুর দেড়টায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। বেগম জিয়ার চেকআপের সময় হাসপাতালের সামনে ছাত্রদল ও বিএনপি কর্মীদের বিক্ষোভ করাকালে ১১ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, বেগম খালেদা জিয়াকে জোর করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কোনো চিকিৎসার কিছুই হয়নি। শুধু হেনস্তা ও হয়রানি করা হয়েছে। তবে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে (বেগম খালেদা জিয়া) দেখে মনে হয়েছে, তিনি সুস্থ আছেন। খালেদা জিয়ার ঘাড়ে ও পিঠেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছয় থেকে সাতটি এক্সরে করা হয়েছে। আজ রিপোর্ট পাব। তারপর রিপোর্টগুলো আজই কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব।’
গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ গণমাধ্যমে প্রচার হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হবে। এরপরই হাসপাতালের সামনের ফটকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। ভিতরে-বাইরে অবস্থান নেয় পুলিশ, র্যাবসহ সাদা পোশাকে ডিবি সদস্যরা।
বেগম জিয়া হাসপাতালে পৌঁছার পরপরই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু রোগীর স্বজন ও গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ তাকে ফটকে আটকে দেয়। তবে বিএনপি নেতা ও আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদারকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এক ফাঁকে ভিতরে প্রবেশ করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান ও তার দুই মেয়ে।মাহবুব উদ্দিন খোকন ও সানাউল্লাহ মিয়া কেবিন ব্লকে বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে বাধা দেওয়া হয় শর্মিলা রহমান ও তার দুই মেয়েকে। এক্সরে শেষে কারাগারে নেওয়ার সময় হাসপাতালের সামনে অবশ্য শর্মিলা রহমান ও তার দুই মেয়ে, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আমানউল্লাহ আমান এবং আইনজীবী নেতারা বেগম জিয়াকে সালাম দেন। এ সময় শর্মিলা রহমানের সঙ্গে সামান্য কথাও হয় বেগম জিয়ার।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে বেগম খালেদা জিয়া যখন কারাগারের উদ্দেশে রওনা দেন তখন তিনি সবাইকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। বেগম জিয়ার পরনে ছিল কালো পাড়ের অফ-হোয়াইট জামদানি শাড়ি। লালচে সোনালি রঙের একটি সানগ্লাস ও গলায় একটি চেন, কানে মতির দুলও দেখা যায়।
সরকারের চিকিৎসায় বিশ্বাস নেই : খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকারের চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস নেই বলে মন্তব্য করেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার এই চিকিৎসা যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট হবে সেদিন, যেদিন তিনি মুক্ত হয়ে নিজের চিকিৎসা নিজেই করাতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘একাকী নির্জন কারাগারে থাকাই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতির অন্যতম কারণ। সেখানে তাঁকে রাখাটাও ষড়যন্ত্রমূলক। ওই রকম পরিবেশে যে কোনো ব্যক্তি থাকলে অসুস্থ হতে বাধ্য।’ ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডে ছিলেন ডা. ওয়াহিদুজ্জামান, ডা. এস এম সিদ্দিকী ও ডা. মামুন রহমান। খালেদা জিয়ার চাহিদানুযায়ী তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. মামুন রহমানকে চেকআপ করার অনুমতি দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।
শাশুড়িকে দেখতে হাসপাতালে কোকোর স্ত্রী : খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁকে দেখতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে উপস্থিত হন তার ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি ও তার দুই মেয়ে। দুপুর ১২টার দিকে দুই মেয়েকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন তিনি। তারা কেবিন ব্লকে ঢুকতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গাড়ির ভিতরে অপেক্ষা করেন। এ সময় জাতীয়তাবাদী মহিলা দলসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেখানে জড়ো হন। একপর্যায়ে সেখানে বিএনপির কর্মীরা স্লোগান দিলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনকে আটক করে। এ সময় হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করেন কোকোর স্ত্রী ও সন্তানরা। বেলা দেড়টার দিকে খালেদা জিয়া বের হওয়ার সময় এক্সরে বিভাগের সামনে বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কোকোর স্ত্রী ও সন্তানদের। এ সময় তারা স্বল্প সময় কথাও বলেন।
আপাতত ভালো আছেন খালেদা জিয়া : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আপাতদৃষ্টিতে ভালো আছেন। তবে তাঁর প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে এক্স-রে রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মিলন মিলনায়তনে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, তাঁর (খালেদা জিয়া) জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তিনি আমাকে বলেছেন, হেঁটে যেতে পারবেন।
হাসপাতাল পরিচালক বলেন, হাসপাতাল থেকে মেডিকেল রিপোর্ট কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। কারা কর্তৃপক্ষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গঠন করা মেডিকেল বোর্ডকে দেবে। বোর্ডই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।
আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন তাঁর পছন্দের চারজন চিকিৎসককে এক্স-রে কক্ষে রাখার অনুরোধ করেছিলেন। সেই অনুযায়ী ওই চিকিৎসকদের সেখানে রাখা হয়। তারা হলেন ডা. ওয়াহিদুর রহমান, ডা. মামুন, ডা. এফ এম সিদ্দিকী এবং কারাগারে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. শুভ।
সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য : যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে প্রস্তুত ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। শুক্রবার রাত থেকেই শাহবাগ, চাঁনখারপুল এলাকায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত র্যাব পুলিশ। পোশাকে এবং সাদা পোশাকে তারা দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগার থেকে শাহবাগ এলাকায় সক্রিয় ছিলেন। রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার শেখ মারুফ হোসেন সরদার বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পিজি হাসপাতালে আসা উপলক্ষে আগে থেকেই আমরা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছিলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রায় একই বক্তব্য র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হকের। তিনি বলেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী সবসময়ই র্যাব ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্তে আসা-যাওয়াকে কেন্দ্র করে আমরাও আগাম ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
‘জোর করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে’ : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অভিযোগ করেন, বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য শুভ নয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়াকে গতকাল জোর করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাঁকে শুধু হেনস্তা ও হয়রানি করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়। গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি। রিজভী আহমেদ বলেন, কারাগারে তাঁর কক্ষের কাছে গিয়ে বার বার তাগিদ দিতে থাকেন কর্মকর্তাসহ সাত-আটজন কারারক্ষী। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে ৩০-৩২ বছর ধরে তিনি (খালেদা জিয়া) শাড়ির ওপর চাদর অথবা ওড়না পরিধান করে আসছেন। তাঁকে চাদর অথবা ওড়না পরিধান করার সেই সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তাঁকে একরকম জোর করেই গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো চিকিৎসাই সেখানে তাঁকে দেওয়া হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের কোনো পরামর্শের সুযোগও দেওয়া হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে চেয়েছেন। কিন্তু সরকার তা করেনি। কাজেই সরকারের উদ্দেশ্য যে অশুভ নয়— এটা আমরা কীভাবে বুঝব?
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, গত পরশুও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক দ্বারা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে প্রধান কারারক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলা হয়েছে। অথচ এর কোনো প্রতিফলন আজকে (গতকাল) দেখা যায়নি। বেগম জিয়া ১৫-২০ বছর ধরে যে চিকিৎসকদের চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের চিকিৎসা প্রদানের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বেগম জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা শুনে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে গেলেও সেখানে পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
খণ্ডবিখণ্ড হবে বিএনপি : খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান নেতৃত্বে থাকলে তার ওপর ‘ঘৃণার কারণে’ বিএনপি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী এ কথা বলেন। তবে বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে সরকারের কোনো চেষ্টা নেই বলেও জানিয়ে দেন তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সদস্য বলেন, বিএনপির অভিযোগ, সরকার বা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করছে। সরকার বা আওয়ামী লীগের বিএনপিকে ভাঙার কোনো ইচ্ছা নেই। এগুলো আপনারা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে আপনারা সরকারে থাকার সময় করেছেন। আমাদের এগুলো করার কোনো অভিপ্রায় নেই। তিনি বলেন, বিএনপি ভাঙবে তারেকের ওপর ঘৃণা থেকে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পর তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজকে যার নেতৃত্বে দল চলছে সে একজন ফেরারি আসামি। আপনাদের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নেতারা একজন ফেরারি আসামির নেতৃত্ব মানতে চায় না, তাকে ঘৃণাভরে দেখেন। এই ঘৃণা করার কারণে বিএনপি ভাঙতে পারে। কামরুল বলেন, তাকে (তারেক রহমান) পছন্দ না করার জন্য বিএনপি ভাঙলে আমাদের কিছু করার নেই। আর এই অপছন্দ করার জন্য বিএনপি ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড হবে, এটাই আমরা মনে করি।