বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এই দুর্নীতির শেষ কোথায়

খাগড়াছড়িতে একটি ঢেউটিনের দাম এক লাখ টাকা, রেলের প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন চার লাখ টাকা, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্পে পানি বিশুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণে ৪১ কর্মকর্তা যাচ্ছেন উগান্ডায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

এই দুর্নীতির শেষ কোথায়

খাগড়াছড়ির এই ঘরটিতে ব্যবহার করা হয় দুই বান টিন। যার দাম ধরা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা ছবি : সংগৃহীত

খাগড়াছড়িতে ঘর মেরামতের কাজে একটি ঢেউটিনের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। রেলওয়ের প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্পে ৪১ কর্মকর্তা পানি বিশুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণের নামে আনন্দ ভ্রমণে গিয়েছেন উগান্ডায়। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের নামে এভাবে চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও হরিলুট। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির শেষ কোথায় তা নিয়ে চলছে সমালোচনা।

এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় খাতে ক্ষমতার অপব্যবহারে এই দুর্নীতির ঘটনাগুলো ঘটছে। জবাবদিহি না থাকায় লাগামহীন অবস্থায় চলে গেছে দুর্নীতি। সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ খাতে ক্রয়, নিয়োগ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। কাগজের সঙ্গে বাস্তব কাজের মিল নেই। টিনের দাম কিংবা বালিশ- প্রতিটি দুর্নীতিই যোগসাজশে হয়। উন্নয়নের নামে লুটপাট করে পরে চলে ভাগ-বাটোয়ারা।’ একটি ঢেউটিন লাখ টাকা : খাগড়াছড়ির আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৬ (এপিবিএন)-এর ঘর মেরামতের কাজে একটি ঢেউটিনের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা, যা বর্তমান বাজারমূল্যের তুলনায় ১০০ গুণেরও বেশি। জানা গেছে, ওই মেরামত কাজে মাত্র দুই বান টিনের দাম দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া কাজ শুরুর মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই বাজেটের ৭১ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ মেরামত কমিটির সদস্যসচিবের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থেকে জানা যায়, চার মাসে কাজের মাত্র ১৫ ভাগ শেষ হয়েছে। এসব সংস্কারসহ অন্য দুটি কাজের দায়িত্বে ছিল মেসার্স তাপস এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স মিশু এন্টারপ্রাইজ। মিশু এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মোহাম্মদ জসিম। অন্যদিকে তাপস এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটিও তারই মালিকানার। এই ৭১ লাখ টাকার মেরামত প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎকালীন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৬ (এপিবিএন)-এর অধিনায়ক (কমান্ডার), বর্তমানে মাদারীপুরের এসপি মাহবুব হাসান। ২০১৮ সালের ১ মার্চ ৪৬ লাখ টাকার সাতটি মেরামত/সংস্কার দরপত্রের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সাড়ে ১১ লাখ টাকার দুটি মডিউল ট্রেন্ড এবং ১৪ লাখ টাকার ড্রেন নির্মাণের কাজও ছিল। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি এপিবিএন-৬-এর সহ-অধিনায়কের বাংলো, ফোর্সের রেশন স্টোর, ফোর্সের দুটি ব্যারাক (আধাপাকা), দুটি পরিদর্শক কোয়ার্টার, ফোর্সের ১৫ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল (আধাপাকা) মেরামত/সংস্কারের কাজ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৩ মার্চ এপিবিএন-৬-এর তৎকালীন কমান্ডার মাহবুব হাসানকে সভাপতি ও উপ-অধিনায়ক শাহনেওয়াজ খালেদকে সদস্যসচিব করে সংস্কারকাজের তদারকি কমিটি গঠন করা হয়। জানা যায়, কাজ শুরুর মাত্র ২২ দিন পর শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে মর্মে প্রত্যয়ন করেন এপিবিএন-৬-এর তৎকালীন অধিনায়ক মাহবুব হাসান। এরপর সংস্কারকাজের বিল বাবদ ৪৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। অথচ এর চার মাস পর সংস্কারকাজ প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজের মাত্র ১৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পরের মাসে আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজের মাত্র ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। রেলওয়ের প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন ৪ লাখ টাকা : ক্লিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা আর অফিস সহায়কের বেতন ৮৪ হাজার টাকা। রেলওয়ের কারিগরি প্রকল্পে এমনই অবিশ্বাস্য বেতন ধরা হয়েছে। সম্প্রতি রেল মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে এ প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ প্রস্তাবকে ‘অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেছে পরিকল্পনা কমিশন। তবে রেল মন্ত্রণালয় দাবি করছে, প্রস্তাবে ভুল হয়েছে। যাতায়াতব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম রেল। এ খাতকে ঢেলে সাজাতে বিভিন্ন সময় নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এর পরও লোকসানের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটি। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে আবারও ২৫৬ কোটি টাকার কারিগরি সহায়তা প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। এর আওতায় বাস্তবায়ন করা হবে ১১টি উপ-প্রকল্প। সম্প্রতি প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি বেতন-ভাতা নির্ধারণে বড় ধরনের অনিয়ম পায়। এর পরই ফেরত পাঠানো হয় রেল মন্ত্রণালয়ে। পরিকল্পনা কমিশনের কার্যপত্রে দেখা যায়, প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন ধরা হয় মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর অফিস সহায়কের বেতন প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা। বিদেশি পরামর্শকদের বেতন মাসে গড়ে ১৬ থেকে ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এ প্রস্তাবকে ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এখন এই বেতন-ভাতা নির্ধারণকে নিছক ভুল বলে দাবি করছে রেল মন্ত্রণালয়। এটি সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, দুর্নীতি বন্ধে প্রকল্প অনুমোদনের আগে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হয়। প্রকল্পের নামে যারা অনিয়ম করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। নিরাপদ পানির জন্য উগান্ডায় ‘প্রশিক্ষণে’ ৪১ কর্মকর্তা : উগান্ডার বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। সেখানে উন্নত পয়োনিষ্কাশন সুবিধারও অভাব। অথচ চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের ২৭ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে ‘প্রশিক্ষণের’ জন্য পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশে পাঠিয়েছে। তাদের সঙ্গে দেশটি ভ্রমণে গেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের আরও ১৪ জন কর্মকর্তা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ‘চিটাগং ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্ট’ (সিডব্লিউএসআইএসপি) বাস্তবায়নের কাজ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এ প্রকল্পের অধীনে ‘ওয়াসার সক্ষমতা বাড়াতে’ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে উগান্ডার ‘ন্যাশনাল ওয়াটার অ্যান্ড স্যুয়ারেজ করপোরেশন’। এজন্য ওয়াসা থেকে প্রায় ১১০ কোটি টাকা নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিই চার ভাগে ওয়াসা ও মন্ত্রণালয়ের ৪১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাদের দেশে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে গেছে। একই প্রকল্পের অধীনে নেদারল্যান্ডসেও গেছেন ১৫ জন কর্মকর্তা। তবে উগান্ডা সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওয়াসা বোর্ডেরই কয়েকজন সদস্য ও সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা। একটি দরিদ্র দেশে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়াকে তারা বলছেন ‘আনন্দ ভ্রমণ’। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি রাখতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এ কাজ করেছে। আর মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রকল্প অনুমোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে। ওয়াসার একজন কর্মকর্তা জানান, এসব সফরে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এ ব্যয় বিশ্বব্যাংক বহন করলেও পরে সুদে-আসলে তা ওয়াসাকেই পরিশোধ করতে হবে।

২০১৬ সালে প্রথম দফায় আট দিনের সফরে উগান্ডা যান ওয়াসার চার কর্মচারী সংগঠনের আটজন নেতা। চার সংগঠন হলো শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের অন্তর্ভুক্ত শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন, নির্দলীয় শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন এবং সরকারদলীয় পরিচয় দেওয়া চট্টগ্রাম ওয়াসা এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন। এরপর ২০১৭ সালের ১৫ থেকে ২৪ ডিসেম্বর দেশটি সফর করেন ১৫ জন। তার মধ্যে আটজন ওয়াসার কর্মকর্তা। অন্যদের মধ্যে ছিলেন তখনকার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবসহ বিভিন্ন দফতরের সাতজন কর্মকর্তা। চলতি বছর ২৬ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত উগান্ডা সফরে যায় তিন সদস্যের ওয়াসার তৃতীয় দলটি। সর্বশেষ ১৩ থেকে ২৩ জুলাই দেশটি সফর করেন ওয়াসার আটজন এবং বিভিন্ন দফতরের সাতজন কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি, টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দুর্নীতি শুরু হয়েছে। কেনাকাটায় আগেও দুর্নীতি ছিল। তবে ১০ টাকার জিনিস ১ হাজার টাকায় কেনার কথা কখনো শুনিনি। উগান্ডায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার! আমরা তাদের চেয়ে অনেক উন্নত। আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ২ হাজার ডলার, তাদের ৭০০ ডলারের মতো। তারা আমাদের কাছ থেকে শিখবে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো দেশে পাঠালে বুঝতাম সেখান থেকে কিছু শেখার আছে। মূলত প্রশিক্ষণের নামে তাদের আনন্দ ভ্রমণে পাঠানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অস্বাভাবিক দামে সরকারি কেনাকাটা হচ্ছে। এটা দুর্নীতির নতুন ট্রেন্ড। বালিশ, পর্দাসহ অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার আরও কয়েকটি ঘটনা আগেও প্রকাশ্যে এসেছে। কোনো শাস্তির কথা তো শুনছি না। ক্লিনারের বেতন ৪ লাখ টাকার বেশি। এটা ভাবা যায়! ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক নির্মাণ হলো বছর দুই। এখনই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মেরামতের জন্য নতুন বাজেট দেওয়া হচ্ছে। সরকার কি তদন্ত করে দেখেছে ব্যয়বহুল রাস্তাটি এত তাড়াতাড়ি নষ্ট হলো কেন? দুর্নীতি-লুটপাটের জন্য কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এটি বেড়েই চলেছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর