বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৯৮ ভাগ গরিব মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৯৮ ভাগ গরিব মানুষ

দেশের ৯৮ দশমিক ৬ ভাগ গরিব মানুষ মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় সবারই আয় কমে গেছে। কাজ হারিয়েছে। তাদের বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই আবার ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব এখন বন্ধ হয়ে গেছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে খাদ্য সুরক্ষা প্রচারকারীদের একটি প্ল্যাটফর্ম রাইট টু ফুড বাংলাদেশ। এদের মধ্যে অনেকেরই ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সংস্থাটি পরিচালিত ‘খাদ্য গ্রহণ এবং দরিদ্র মানুষের পুষ্টির ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই সাম্প্রতিক সময়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেননা এই করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। একইভাবে কমেছে নতুন চাকরির সুযোগ। তাদের প্রায় সবাই পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছেন না। কেননা তারা আর্থিক সংকটে ভুগছেন। এতে প্রায় ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের জন্য সমস্যায় পড়েছেন। এমনকি এপ্রিল ও মে মাসে দেশব্যাপী বন্ধের (লকডাউন) সময় দরিদ্রদের মধ্যে পাঁচ শতাংশই এক দিন একই ধরনের খাবার খেয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বেঁচে ছিলেন। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ময়মনসিংহ ও সিলেটে খাবারের ঘাটতি তুলনামূলকভাবে বেশি। দরিদ্রশ্রেণি, বিশেষত শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের পুষ্টির অবস্থা এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ সরকারি বা বেসরকারি খাত থেকে সামান্য কিছু সহায়তা পেয়েছিলেন সে সময়। ওই সময় তারা শুকনো খাবার, নগদ অর্থ বা রান্না করা খাবার পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট ছিল না বলে জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে।  এই প্ল্যাটফর্মের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, ‘সরকারের উচিত গরিবদের সহায়তা বাড়ানো। বেসরকারি খাতকে এ-সংক্রান্ত কর্মকান্ডে আরও এগিয়ে আসতে হবে, যাতে অন্যরাও উৎসাহিত হয়।’ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ আরও বলেন, ‘মহামারী চলাকালীন আমরা খেয়াল করেছি যে খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’

এই জরিপ পরিচালনার মূল লক্ষ্য ছিল কভিড-১৯ মহামারীর ফলে দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে। তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছেন। বিশেষ করে খাদ্য গ্রহণ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দরিদ্র মানুষের পুষ্টির অবস্থা বোঝার জন্য। এই সমীক্ষাটি করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে দরিদ্র মানুষের সচেতনতার বিষয়টিও অনুসন্ধান করতে চেয়েছিল। এ জন্য সংস্থাটি দেশের সব বিভাগের ৩৭টি জেলার ৮৩৪ জন দরিদ্র মানুষের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ চালায়।

যাদের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়, তারা রিকশা, ভ্যান, স্কুটার ও ট্যাক্সিচালক, পরিবহনশ্রমিক, ছোট দোকানদার, রাস্তা বা ফুটপাথের বিক্রেতা, নাপিত, বিউটি পারলার কর্মী, আবর্জনা সংগ্রহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, খ-কালীন গৃহকর্মী, ছোট ছোট ওয়ার্কশপের কর্মী, রাস্তায় টুকরি সাজিয়ে জিনিসপত্র বিক্রেতা, ব্যক্তিগত গাড়িচালক, পাবলিক পরিবহনের চালক, মালবাহী গাড়ির চালক, এসব গাড়ির শ্রমিক, ই-কমার্সের ডেলিভারিম্যান, কৃষিশ্রমিক ও দিনমজুর। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। তাই তারা দিনে একবারের বেশি খেতে পারেননি সে সময়। কেননা তাদের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া এই জরিপে ভিক্ষুক, পথশিশু এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মতো বেকারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। মহামারী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সব ধরনের অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, অফিশিয়াল, গণপরিবহন পুরোপুরি বন্ধ রাখতে সাধারণ ছুটি কার্যকর করে। ওই সময় দেশের বেশির ভাগ মানুষই অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। এরই মধ্যে অনেকেই চাকরি হারান। অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ৬৬ দিন পর মে মাসের প্রথম দিকে সরকার সাধারণ ছুটি তুলে নিলে আবার সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু জরিপে উঠে এসেছে, সাধারণ ছুটির পর অফিস-আদালত, কারখানা, দোকানপাট খুললেও এখনো মানুষের অর্থনৈতিক সংকট কাটেনি। এ সময় যারা পেশা বদলেছেন, তাদের বেশির ভাগ দিনমজুর ও কৃষিশ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। কারণ এটি দিয়ে কাজ শুরু করা তুলনামূলক সহজ। মহামারীর কারণে প্রায় ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ বেঁচে থাকার জন্য পেশা পরিবর্তন করেছেন সে সময়। মহামারীর সময়ও কৃষিশ্রমিকরা অব্যাহতভাবে কাজ করে যাওয়ায় এবং জরুরি খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থা সচল থাকায় এই শ্রমিকরা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে বোরো ধান কাটা কিংবা মাড়াইয়ের কাজ করতে পেরেছেন। সমীক্ষায় নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস দ্বারা চালিত জীবিকার ক্ষতির কারণে দরিদ্র মানুষের আয়ের ক্ষতি হয়েছে। এই ব্যক্তিদের ন্যূনতম সঞ্চয় বা মোটামুটি কোনো সঞ্চয়ও নেই। তাই আয় কমে যাওয়ায় খাদ্যচাহিদা মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে, যা পুষ্টিচাহিদার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিনি জানান, এই মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পরে, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও দুস্থদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য করা হয়। এ-জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে নগদ অর্থ, খাবার ও রান্না করা খাবারের বিতরণ হয়।

জরিপে বলা হয়, এটি লক্ষণীয় যে প্রাক্্-মহামারী অবস্থায়, প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ লোক দিনে তিনবার খাবার গ্রহণ করতেন। বাকিরা গ্রহণ করতেন দুইবার। যদিও বেশির ভাগ উত্তরদাতারাই দিনে তিনবার খাবার গ্রহণ করতেন, সাধারণ ছুটির সময়, বিভিন্ন বিভাগের ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ উত্তরদাতা তিন দিনের খাবার মজুদ রাখতে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হন। সব বিভাগেই দরিদ্র মানুষেরা মূলত পর্যাপ্ত খাবারের ঘাটতি এবং পুষ্টিকর খাবারের তীব্র অভাবে ভুগছিলেন। প্রায় ৮৮ দশশিক ৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে চরম অসুবিধার মুখোমুখি হন। রংপুর অঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা খাদ্য সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। পুষ্টিকর খাদ্য সংকটে যারা পড়েছিলেন তারা রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। এখনো স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো খাদ্য সরবরাহের সমস্যায় রয়েছে, যা তাদের পরিবারকে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির সামনে ফেলেছে। গত তিন মাসে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, ঘরে এবং বাইরে কিছু মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কভিড-১৯ মোকাবিলা করছে মানুষ।

এই জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই করোনাভাইরাস সম্পর্কে অবগত ছিলেন। সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয় দরিদ্রদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ জরুরি। প্রয়োজনে দরিদ্র জনগণের জন্য দ্রুত সহায়তা সরবরাহ করা উচিত। বিশেষ শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোগের জন্য সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত, যা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হলে অনেক দরিদ্র মানুষের জন্য জীবিকার সুযোগ তৈরি করবে।

সর্বশেষ খবর