কাকরাইলে লকডাউনের মধ্যে এক রিকশাওয়ালা রাস্তায় নামলে তাকে রিকশাসহ আটক করে পুলিশ। তাকে জরিমানা করা হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। ঘরে খাবার না থাকা, আর কিস্তির টাকা পরিশোধ করার চাপ থাকায় তিনি লকডাউনের পঞ্চম দিনে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। আটক হওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলছিলেন, চার দিন ঘরে থাকার পর বেরিয়ে সারা দিনে মাত্র ১৫০ টাকা ইনকাম করেছেন। বাসায় কোনো খাবার নেই। তিনি এখন ১২০০ টাকা দেবেন কোথা থেকে? তিনি বলেন, ‘করোনা রোগকে হয়তো কিছু দিন মানাতে পারব। কিন্তু পেট তো আর একদিনও মানবে না। আবার রিকশা কেনার কিস্তিও দিতে হবে। এখন আমার কী হবে?’ তার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
শুধু ওই রিকশাওয়ালাই নন, তার মতো অতি ক্ষুদ্র আয়ের হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ জীবিকা ও পেটের তাগিদে এখন লকডাউন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছে। ক্ষুধার্ত মানুষ নিরুপায় হয়েই রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। অলিগলির দোকানগুলো খুলতে শুরু করেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাজপথে বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি, রিকশা ও পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যা। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। কার্যত, মানুষ আর ঘরবন্দী হয়ে থাকতে চাচ্ছে না। জীবিকার তাগিদে সবাই এখন বের হয়ে আসছে।
সরকার ঘোষিত ‘সর্বাত্মক কঠোর’ লকডাউনের গতকাল ছিল নবম দিন। ঢাকাসহ সারা দেশে অনেকটা ঢিলেঢালাই ছিল এই লকডাউন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে লকডাউনের শুরুতেই কলকারখানা খোলা ছিল। এরমধ্যে সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও চালু হয়েছে। আন্তর্জাতিক কয়েকটি ফ্লাইটও চলছে। দুই-এক দিনের মধ্যে শপিং মল, মার্কেটসহ দোকান খুলে দেওয়ার চিন্তাও করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে সরকার ঈদের আগে নতুন করে আর লকডাউনে যাচ্ছে না বলেও আভাস পাওয়া গেছে।জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন যে ধরনের লকডাউন চলছে তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। লকডাউন হলে তা বাস্তবে কার্যকর করতে হবে। করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনে কারফিউ জারি করতে হবে। জীবন-জীবিকার বিষয়টি সরকারকে অন্যভাবে ভাবতে হবে। কিন্তু লকডাউনের নামে সড়কে মানুষ আর গাড়ি যেভাবে বেড়েই চলেছে, তা তেমন কোনো ফল বয়ে আনবে না।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আধাআধি লকডাউনে কোনো উপকার আসবে না। লকটাউন করলে পুরোপুরি করতে হবে। সেজন্য সবাইকে একটু সেক্রিফাইস করতে হবে। অবশ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে কওে, তা অনুসরণ করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারকে সে ধরনের প্রস্তুতিও নিতে হবে। কিন্তু আধাআধি লকডাউনে কোনো উপকার আসবে না। এখানে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের দেশে করোনার যে ঊর্ধ্বগতি, তাতে লকডাউনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা হতে হবে শক্ত। কারণ, করোনার সংখ্যা কেমন হতে পারে এ নিয়ে আমাদের ব্যাপকভাবে গবেষণা নেই।’
এদিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা, রামপুরা মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, নয়াপল্টন, মগবাজার, মহাখালী ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার অনেক দোকানপাটই খোলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখেও সেগুলো না দেখার ভান করে থাকছে। এসব এলাকায় অলিগলির সব দোকানই স্বাভাবিক সময়ের মতো মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকছে। গতকাল মহাখালী আইসিডিডিআরবি সড়ক ধরে সাতরাস্তার দিকে এগোতেই কয়েকটি টায়ার-ব্যাটারির দোকান খোলা দেখা গেছে। দোকানিরা বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে ব্যবসা বন্ধ থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। সামনে ঈদ, আসছে বাড়তি খরচ। তাই বাধ্য হয়ে দোকান খুলতে হয়েছে।’ গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ওই সড়কে গাড়ি সার্ভিসিংয়ের কয়েকটি দোকান খোলা দেখা গেছে।
কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউনের কোনো বালাই নেই কাঁচাবাজারে। সেখানে মানুষ আর মানুষ। কোনো রকম সামাজিক দূরত্বও মানা হচ্ছে না। রামপুরা, মধ্যবাড্ডা, উত্তরবাড্ডা, শাহজাদপুর, মৌচাক, মতিঝিলের কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, লকডাউনের আগের দিনগুলোর মতোই স্বাভাবিকভাবে মানুষ কেনাকাটা করছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারেও উদাসীন ক্রেতা-বিক্রেতারা। সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের পরও খোলা থাকছে দোকানপাট। উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারে জসিম মিয়া নামে এক সবজি বিক্রেতা বললেন, ‘কয়েক দিন ধরে বাজারে ক্রেতা কিছুটা কম। কারণ লকডাউনের আগে মানুষ সপ্তাহের খাবার মজুদ করেছে।’ উল্লেখ্য, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে প্রথম দফায় ৫ এপ্রিল সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। সেই বিধিনিষেধ মানতে সর্বস্তরের মানুষের ছিল সর্বোচ্চ অনীহা। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ রাস্তায় নামে। এরই মধ্যে গত ১৪ এপ্রিল থেকে আবার সারা দেশে ‘সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন’ দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার শেষ হওয়া সেই লকডাউন আবার বেড়ে গড়ায় আরেক সপ্তাহে। ২৮ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত এই সর্বাত্মক লকডাউন চলবে।