সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

সংকটে জর্জরিত সরকারি হাসপাতাল

চিকিৎসক নার্সসহ সব জেলায় জনবল সংকট । টেকনিশিয়ানের অভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় নষ্ট হচ্ছে ছুটির দিন বন্ধ থাকে বহির্বিভাগ ও প্যাথলজি । ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ । চাপ বাড়ছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোয়

মাহমদু আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

সংকটে জর্জরিত সরকারি হাসপাতাল

সংকটের শেষ নেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয়। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব হাসপাতালেই চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী সংকট। অধিকাংশ হাসপাতালে আধুনিক মানের যন্ত্রপাতি নেই। কোথাও যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ান। সংশ্লিষ্ট জনবলের অভাবে বিকল হয়ে আছে অনেক যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া ছুটির দিনে বন্ধ থাকে বহির্বিভাগ ও প্যাথলজি। অধিকাংশ হাসপাতালই অপরিচ্ছন্ন। নোংরা টয়লেটের দুর্গন্ধে রোগীর স্বজনের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সরকারি হাসপাতালগুলোর নানামুখী সংকট কাটানো যায়নি। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর নানামুখী সমস্যায় রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চাপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ দিনক্ষণ বুঝে হয় না। প্রতিদিনই নানা জটিল রোগী হাসপাতালে আসছেন। তাই ২৪ ঘণ্টা রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ জরুরি। জানা যায়, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সরকারি হাসপাতালের অধিকাংশেরই আউটডোর বা বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ছুটির দিনে সরকারি হাসপাতালগুলোয় জরুরি বিভাগ খোলা থাকলেও বহির্বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় ছোট দুর্ঘটনা, জ্বর, মাথা ও পেটে ব্যথা, পেটে সমস্যা, বমি এবং সর্দি-কাশির মতো অসুখে ভুক্তভোগীদের চিকিৎসার জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের পড়তে হয় সমস্যায়। জানা যায়, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চিকিৎসকরা শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি উপভোগ করেন। কিন্তু যে পেশার সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যু জড়িত, সেখানে ছুটির দিনে রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করে সীমিত পরিসরে বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা চালু করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) হিসাব অনুযায়ী দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৭৫ হাজার চিকিৎসক ও ৩২ হাজারের মতো নার্স রয়েছেন। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ২ হাজার ২৬৭ জনের জন্য রয়েছেন একজন চিকিৎসক। এ ছাড়া ৫ হাজার ৩১৩ জনের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে রয়েছেন একজন নার্স। সারা দেশের জরুরি রেফার্ড রোগীদের চাপ পড়ে ঢাকার বিশেষায়িত ও সাধারণ হাসপাতালগুলোয়। ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর ৫০ শতাংশই দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার্ড হয়ে আসা। নয় তো সেখানে সেবা না পেয়ে ঢাকায় এসেছেন। কয়েক বছর ধরেই অসংক্রামক রোগের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। কিন্তু জেলা সদরের হাসপাতালগুলোয় ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৩০০ শয্যায় এসব রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব। হাসপাতালের আশপাশে বিভিন্ন ভবনের বারান্দায় সারা বছর থাকতে দেখা যায় ক্যান্সার রোগী ও স্বজনদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকেও ক্যান্সার রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে বড় একটি অংশ দেশের বাইরে চিকিৎসা করায়। উচ্চবিত্তরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার জন্য যান। মধ্যবিত্তরা যান ভারতে। যাদের অন্য দেশে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই তারা রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় অসহায় পরিস্থিতিতে পড়ে থাকেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেলা উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকরা যেতে চান না। আবার অনেকে সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে বেশি মনোযোগী হন প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। এটা অন্যায়। তবে সবই নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। সরকার চাইলে চিকিৎসকরা গ্রামমুখী হতে বাধ্য। নইলে তাদের সনদ বাতিল করতে হবে। তা ছাড়া জনবলসহ অন্য যে সংকটগুলো আছে তা-ও সরকার উদ্যোগ নিলে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে আমি মনে করি।’

বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রহমান টুলু জানান, নানা সংকটে পড়েছে জেলার দুটি সরকারি হাসপাতাল। করোনা চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে গড়া হলেও বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে মাত্র দুটি। যে কারণে বগুড়ায় বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত অক্সিজেন সংকটে পড়ে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। রোগীর চাপ বাড়ায় জেলায় করোনা পরীক্ষার ফলাফল পেতেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত দিন। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রয়োজনীয় জনবল সংকট নিয়েই সেবা দেওয়া হচ্ছে।

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৪১২ জন থাকার কথা। আছেন ৩০০। পরিচ্ছন্নতা কর্মী ১২৯ জন প্রয়োজন। কাজ করছেন ৯২ জন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য আছে। হাসপাতাল চত্বরে তারা সকাল থেকে ভিড় করে থাকেন। ৫০০ শয্যা হাসপাতালের বিপরীতে ২ শতাধিক চিকিৎসকের মধ্যে ৫৫টি পদ শূন্য।

বিশ্বনাথ (সিলেট) প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম বেগ জানান, বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও তা চালু হয়নি দুই যুগেও। সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া ও গাইনি ডাক্তারের অভাবে অকেজো পড়ে আছে অপারেশন থিয়েটার (ওটি)। বন্ধ রয়েছে সিজারিয়ানসহ জটিল ও কঠিন অপারেশন। এতে ভোগান্তিতে রয়েছেন দরিদ্র রোগীরা। সরকার কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে স্বয়ংক্রিয় আধুনিক অপারেশন থিয়েটার স্থাপন করলেও তা কাজে লাগছে না সেবাপ্রত্যাশীদের। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হওয়ার উপক্রম অপারেশন থিয়েটারের অ্যানেসথেসিয়া মেশিনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। হাসপাতাল তৈরির শুরুর দিকে অপারেশন থিয়েটার চালু থাকলেও জনবল সংকটে ২৪ বছর ধরে তা বন্ধ। প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি আছে। কেবল সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া ও গাইনি কনসালট্যান্ট না থাকায় বন্ধ রয়েছে অপারেশন। এতে বিকল হওয়ার পথে কয়েক লাখ টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো. রফিকুল আলম জানান, কাগজে-কলমে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ১০০ শয্যার জনবলও নেই। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত জেলাবাসী। প্রতিদিন গড়ে এ হাসপাতালে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। ১০০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক প্রয়োজন ৪২ জন। আছেন মাত্র ১৯ জন। ১৭৫ জন নার্সের স্থলে কর্মরত ১৭০ জন। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী প্রয়োজন ২৫৫ জন। আছেন ২১ জন। হাসপাতালে নিউরোসার্জারি, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, অর্থোপেডিক ও বক্ষ বিশেষজ্ঞ দীর্ঘদিন না থাকায় রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারছেন না। অন্যদিকে হাসপাতালের পুরনো ভবনে টয়লেটসহ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই নাজুক।

দিনাজপুর প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম জানান, জেলার অলিগলি বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিকে ছেয়ে গেছে। এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালে রোগী নেওয়ার জন্য সরকারি হাসপাতালের সামনে অবস্থান করছেন দালালরা। এসব দালালের কারণে বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাধারণ ডেলিভারি রোগী অনেক কমে গেছে। সেবা নিতে আসার পথে তারা ভুল বুঝিয়ে রোগী নিয়ে যান বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। এ অবস্থা অন্যান্য উপজেলা হাসপাতালেরও। এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালে সেবার পরিবর্তে শুরু হয়েছে প্রসূতি সিজারের নামে এক ধরনের ব্যবসা। অর্থের লোভে তাদের হয়ে কাজ করছে দালাল চক্র।

ফরিদপুর প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সোহেল জানান, চিকিৎসক সংকট তীব্র হওয়ায় অনেকটা খুঁড়িয়ে চলছে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, ৩৭ চিকিৎসকের বিপরীতে রয়েছেন সাতজন। এ ছাড়া ছয় মাসের অধিক সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে এক্স-রে মেশিন। চিকিৎসকের অভাবে অচল হয়ে পড়ে আছে আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনটিও। এ ছাড়া অন্যান্য যন্ত্রপাতিও তেমন একটা নেই। শুধু চিকিৎসক সংকটই নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরও সংকট রয়েছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালটিতে কেউ ছোটখাটো সেবা নিতে এলে তাদের নানা অজুহাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ ছাড়া অনেক সময় এখানে সেবা না দিয়ে দালালদের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রোগীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম ইচ্ছা করেই কমিয়ে রাখছে একটি চক্র। হাসপাতালে প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি। মাদকাসক্ত একটি চক্র হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ বুঝে তারা রোগী ও স্বজনদের টাকা, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিস হাতিয়ে নিচ্ছে।

গাজীপুর প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম জানান, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, লোকবল, অবকাঠামোর অভাবসহ নানা সমস্যার মধ্যে চলছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম। চিকিৎসক ও অন্য কর্মচারীদের শূন্যপদে দ্রুত পদায়নের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। স্থান ও শয্যার অভাবে অনেক রোগীকে বারান্দার মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। বাসস্থানের অভাবে প্রায় সব চিকিৎসকই হাসপাতালের বাইরে অবস্থান করেন। হাসপাতাল ভবনের ১৫ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট হাসপাতালটি ৫০০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য মঞ্জুরিকৃত ৬৬৬ পদের মধ্যে পূরণ হয়েছে ৫৫১টি। আউটসোর্সিং ভিত্তিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কাজ করছেন ৯০ জন। বর্তমানে হাসপাতালে শূন্যপদ ১১৫টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ১৯, তৃতীয় শ্রেণির ৬৪, চতুর্থ শ্রেণির ৩১টি। হাসপাতালে ওষুধ রাখার জন্য পর্যাপ্ত রিজার্ভ স্টোররুম নেই। হাসপাতালটি ১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও চারদিকে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। হাসপাতালে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের দৌরাত্ম্য দীর্ঘদিনের। চারটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একটি বেশির ভাগ সময়ই নষ্ট থাকে। সে সুযোগে একটি প্রভাবশালী মহল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকের সামনেই অ্যাম্বুলেন্স রেখে ব্যবসা করছে। রোগীদের অভিযোগ, এক্স-রেসহ অন্য বেশির ভাগ পরীক্ষা তারা বাইরের ক্লিনিক থেকে করিয়ে আনতে বাধ্য হন। এ হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন জানান, কভিড ও নন-কভিড দুটিরই চিকিৎসা চলছে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালটি। গত বছরের ১৪ এপ্রিল করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয় এ হাসপাতালে। জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির ক্যাডার চিকিৎসকের ৬৮ পদই শূন্য। নন ক্যাডার প্রথম শ্রেণির দুটি পদের সবই শূন্য। সিনিয়র স্টাফনার্সের ৩৪২ পদের মধ্যে ১৩২, দ্বিতীয় শ্রের্ণির পাঁচ পদের দুটি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১৩৯ পদের ১২৯টি শূন্য। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে টেকনিশিয়ান সংকটে। ৫৬ পদে কর্মরত মাত্র তিনজন। ফলে রোগীদের উচ্চমূল্য দিয়ে বাইরের ল্যাব থেকে বেশির ভাগ পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটের কারণেও চিকিৎসা কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। এখানে এমআরআই মেশিন নেই।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি রেজাউল করিম মানিক জানান, জনবল সংকট আর অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালসহ জেলার পাঁচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। জেলার ১৬ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র ১০০ শয্যার এ হাসপাতালটি কার্যত চলছে খুঁড়িয়ে। চিকিৎসক সংকট থাকায় উপসহকারী মেডিকেল অফিসার, প্যারামেডিকস ও ডেন্টাল টেকনিশিয়ান দিয়ে হাসপাতাল চলছে।

জানা গেছে, রোগীদের জন্য সরকারিভাবে এ হাসপাতালে প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হলেও রোগীদের রোগ পরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকে। ‘ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন নেই’ অজুহাতে হাসপাতালে আগত রোগীদের ডিজিটাল এক্স-রে করাতে বাইরে ব্যক্তিমালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। রোগীরা অভিযোগ করেন, এক্স-রে এবং প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের ডাক্তাররা হাসপাতালের আশপাশের কয়েকটি ডিজিটাল এক্স-রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক। ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় এ হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন কেনা হয় না। আন্তর ও বহির্বিভাগের রোগী, স্বজন এবং চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি আর দলবাজি গ্রাস করে আছে জেলা সদর হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার হাসপাতালগুলোয় সপ্তাহের দুই দিন মাংস, দুই দিন ডিম ও দুই দিন মাছ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সপ্তাহজুড়েই দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের বিভিন্ন মাছ। দলীয় প্রভাবের কারণে হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী দিনের শুরুতে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন ব্যবসা, রোগীর দালালিসহ আয়বর্ধক ধান্ধায়। প্রতিটি শিফটে পাঁচ-ছয় জন করে নার্স প্রতিটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও বাস্তবে দু-এক জনের বেশি থাকেন না।

মাদারীপুর প্রতিনিধি বেলাল রিজভী জানান, মাদারীপুরে ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি চলে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ শেষ হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় হাসপাতালটি চালু হচ্ছে না। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন চিকিৎসক সংকট ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনুপস্থিতিসহ নানা সমস্যায় ব্যাহত হচ্ছে সদর হাসপাতালের কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি না করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা অন্য কোনো বেসরকারি হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দক্ষ টেকনিশিয়ান না থাকায় করা যাচ্ছে না আলট্রাসোনোগ্রাম ও উন্নতমানের পরীক্ষা, নষ্ট হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা নিয়মিত রোগীও দেখেন না।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি সরকার হায়দার জানান, পঞ্চগড়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিদারুণ সংকট চলছে। জেলার একমাত্র সদর আধুনিক হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। নেই অক্সিজেন প্লানটেশন। তাই গুরুতর রোগীরা দিনাজপুর অথবা রংপুরের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তাদের খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ এ জেলায় দিন দিন বাড়ছেই। আইসিইউ এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ না থাকায় জটিল আকার ধারণ করা রোগীদের পাঠানো হচ্ছে রংপুর অথবা দিনাজপুর। এ কারণে আক্রান্তদের ব্যয় বাড়ছে। একদিকে কভিড আক্রান্তের ফলে পারিবারিক দুশ্চিন্তা অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছেন।

আটোয়ারী উপজেলার কাটালী গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত মাসের শেষের দিকে করোনা টেস্টে পজিটিভ হলে পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি হন। আইসিইউ না থাকায় ফুসফুস আক্রান্ত হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে দিনাজপুরে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঝুঁকি নিতে চান না। তিনি জানান, দিনাজপুরে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে তার বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। পঞ্চগড় হাসপাতালে আইসিইউ থাকলে এতটা ব্যয় হতো না।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি মো. কাবুল উদ্দিন খান জানান, নামেই মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কার্যক্ষেত্রে ১০০ শয্যা হাসপাতাল রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক লোকবল দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালটি। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি থাকলেও লোকবলের অভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। দুটি সুবিশাল ভবনের একটিতে নেই জেনারেটর। শুধু টেকনিশিয়ানের অভাবে সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকার পরও কোনো কাজে আসছে না। বাধ্য হয়ে অধিক টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে যেতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, অনেকের ক্লিনিকের ব্যবসা রয়েছে। মেশিন নষ্ট থাকার কথা বলে দালালরা রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে যায় ক্লিনিকে।

১০০ শয্যার হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও শুধু নার্স নিয়োগ দেওয়া ছাড়া বাড়ানো হয়নি অন্য জনবল। আবার বেশির ভাগ নার্সের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনরা। সরকার পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করলেও ইনডোর ও আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসাদের বেশির ভাগ ওষুধ বাইরে থেকেই কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া দালালের দৌরাত্ম্যে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক রোগী। ক্লিনিক ও ডায়াগানস্টিক সেন্টারের নিয়োগকৃত দালালরা এ দুর্ভোগ পুঁজি করে প্রতারিত করছেন রোগীদের। নির্দিষ্ট সময় পার হলেও কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি চালু হয়নি। এখনো অনেক কাজ বাকি। মাত্র কয়েকজন ডাক্তার বহির্বিভাগে রোগী দেখেন। ফলে রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, নানা সংকটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মস্তানগর হাসপাতাল এখন নিজেই রোগী। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে ১৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য। এতে চিকিৎসকরা যেমন সেবা দিতে সমস্যায় পড়ছেন, তেমনি রোগীরাও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক রয়েছেন এর মধ্যে সাতজন করোনাকালীন অন্যত্র দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া দুজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার ৬ লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার জন্য একমাত্র সরকারি হাসপাতাল এটি। জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে। ২০১২ সালে নষ্ট হওয়ার পর হাসপাতালে নতুন এক্স-রে মেশিন কেনা হয়নি। কয়েকবার মেরামত করা হলেও এখন আর পুরনোটা ব্যবহার হচ্ছে না। অবশ্য উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দাবি করেছেন এক্স-রে মেশিন রাখার কক্ষটি ব্যবহারের অনুপযোগী। এ ছাড়া ভবন সংকটও আছে। চিকিৎসক ও কর্মচারীদের জন্য উপযুক্ত আবাসনব্যবস্থা নেই।

নড়াইল প্রতিনিধি সাজ্জাদ হোসেন জানান, নড়াইল সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে ডাক্তারসহ জনবল সংকট থাকায় সেবা চরম বিঘিœত হচ্ছে। ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে ৩৮ চিকিৎসকের স্থলে আছেন ১৬ জন। এসব পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় ভর্তি ও আউটডোরের রোগীরা সেবা নিতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনার সম্মুখীন হচ্ছেন। হাসপাতালের শৌচাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকায় দুর্গন্ধে রোগীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলে হাসপাতাল চত্বরে পানি জমে যায়। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের রয়েছে দৌরাত্ম্য।

হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, পাঁচটি এক্স-রের মধ্যে তিনটি বিকল, পাঁচটি অ্যানেসথেসিয়ার মধ্যে চারটি বিকল এবং দুটি আলট্রাসনো মেশিন বিকল। চারটি ভেন্টিলেটর মেশিনের মধ্যে দুটি চালু করা হলেও বাকি দুটি প্যাকেটবন্দী। দুটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি সচল।

নেত্রকোনা প্রতিনিধি আলপনা বেগম বলেন, জেলার ১০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২৩৩টি। চিকিৎসক রয়েছেন ১৩৬ জন। বাকি পদ শূন্য বছরের পর বছর। পূর্বধলায় ৩১ পদের মধ্যে ১৭, দুর্গাপুরে ১৮ পদের মধ্যে ৭, বারহাট্টায় ১৭ পদের মধ্যে ৫, কলমাকান্দায় ২৯ পদের মধ্যে ১৪, মোহনগঞ্জে ২৮ পদের মধ্যে ১১, খালিয়াজুরীতে ১৭ পদের মধ্যে ৮, মদনে ২৯ পদের মধ্যে ১৩, আটপাড়ায় ১৭ পদের মধ্যে ৬, কেন্দুয়ায় ৩৪ পদের মধ্যে ১৪ ও সদরে ১৫ পদের মধ্যে ২টি শূন্য।

জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গছে মেডিসিনের জুনিয়র কনসালট্যান্টসহ সার্জারি, গাইনি, শিশু, কার্ডিওলজি, ইএনটি, চর্ম ও অর্থোপেডিকের নানা পদ শূন্য। শূন্য জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসারের পদও।

সনোলজিস্ট না থাকায় নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে হয় না আলট্রাসনোগ্রাম। মেশিন থাকলেও বিকল পড়ে আছে বছরজুড়ে। এ ছাড়া করোনাকালে নেই পিসিআর ল্যাব। যে কারণে ময়মনসিংহ থেকে নমুনা পরীক্ষা করাতে হয়। তবে এ বছর থেকে জিন এক্সপার্ট ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু হলেও তা একেবারে স্বল্পসংখ্যক।

চিকিৎসকের শূন্যতা নিয়ে নেত্রকোনার সিভিল সার্জন ডা. সেলিম মিয়া জানান, সব হাসপাতালের শূন্যপদ পূরণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। সময় সময় চিকিৎসক পোস্টিং দেওয়া হলেও সব শূন্যপদে দেওয়া হয় না। ফলে কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।

নোয়াখালী প্রতিনিধি আকবর হোসেন সোহাগ জানান, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দৃষ্টিনন্দন ভবন থাকলেও ওষুধ, চিকিৎসকসহ লোকবল সংকটে বেহাল নোয়াখালীর স্বাস্থ্যসেবা। অপরিচ্ছন্ন আঙিনা আর রোগীর তুলনায় দর্শনার্থীর ভিড় দেখলেই বোঝা যায় অব্যবস্থাপনা চরমে। জোড়াতালির করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল থাকলেও নেই উন্নত চিকিৎসা। অপ্রতুল সেবায় দিশাহারা রোগী ও স্বজনরা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, সাধ্যের মধ্যে সবটুকু দিয়ে সেবা দিচ্ছেন তারা। ‘চর আলগী ২০ শয্যা আধুনিক হাসপাতাল’ ২০০০ সালে সৌদি সরকারের আর্থিক অনুদানে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় স্থাপিত হয়। সরকারি এ হাসপাতালটি এখন নামেই আধুনিক। শুরুতে চিকিৎসকসহ ৩২ জনবল থাকলেও এখন রয়েছে চারজন। আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে, ইসিজি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক অপারেশন থিয়েটার থাকলেও এখন সবই অকেজো। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য উচ্চক্ষমতার জেনারেটরটিও বিকল। ২০ বছরেও হাসপাতালটি মানুষের সামান্যটুকু সেবাও নিশ্চিত করতে পারেনি। অথচ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ সেবা নিতে পারতেন এ হাসপাতাল থেকে।

একই দশা জেলার নয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। দৃষ্টিনন্দন ভবন ও বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও শুধু ওষুধ, জনবল সংকট আর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা না থাকায় নিশ্চিত হচ্ছে না সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা। ফলে চাপ পড়ছে ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে। এখানে প্রতিদিন বহির্বিভাগে সহস্রাধিক রোগী আসেন। ২৫০ শয্যার হলেও ভর্তি থাকেন ৫ শতাধিক। রোগীদের অভিযোগ, বেশির ভাগ ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও রোগীদের দেখিয়ে দেওয়া হয় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সময়মতো দেখা মেলে না চিকিৎসকের। চিকিৎসক-নার্স ও আয়া-বয়দের দুর্ব্যবহারেরও শিকার হয় রোগী-স্বজনদের। আবাসিক চিকিৎসক থাকলেও তদারকি না থাকায় হাসপাতালের ভিতরে সিএনজি অটোরিকশা ও অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। গরু-ছাগল ও হকারের বিচরণ তো রয়েছেই। ওয়ার্ডগুলোয় রোগীর চেয়ে দর্শনার্থীর ভিড় বেশি। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে দুর্বিষহ অবস্থা রোগীদের। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে জোড়াতালি দিয়ে জেলা শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে ১২০ শয্যা কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল নির্মাণ করা হলেও সংকট চরমে। এ হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা রোগী। ৪০-৫০ জন করে রোগী ভর্তি থাকছেন এখানে।

পটুয়াখালী প্রতিনিধি সঞ্জয় দাস লিটু জানান, জেলায় দেড় যুগ ধরে হাই ভোল্টেজের জেনারেটর বাক্সবন্দী পড়ে আছে করিডোরের মেঝেতে। জেনারেল হাসপাতালে আছে ডাক্তার সংকট। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্য দিয়েই শুধু পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জেলার আট উপজেলার একটিতেও হাসপাতাল নেই। বাকি হাসপাতালে ডাক্তার সংকটের মধ্যেই চলছে সেবা। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে অনেক হাসপাতালে রোগীদের নামমাত্র সেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। রাঙাবালিতে হাসপাতাল না থাকায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের দেড় লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা যেন স্বপ্নের মতো। জানা যায়, সিনিয়র কনসালট্যান্টের ১০ পদ থাকলেও শুধু গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া, মেডিসিন, চক্ষু, চর্ম ও যৌন ছাড়া অন্য চারটি পদ শূন্য। জুনিয়ার কনসালট্যান্টের ১১ পদে কর্মরত আছেন মাত্র ছয়জন। আবাসিক ফিজিশিয়ান, আবাসিক সার্জন পদ দুটি শূন্য। ডেন্টাল সার্জন, প্যাথলজিস্ট কর্মরত থাকলেও অ্যানেসথেসিস্টের তিনটিসহ রেডিওলজিস্ট পদ শূন্য। মেডিকেল অফিসারের ১০ পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র তিনজন। সহকারী রেজিস্ট্রারের ১১ পদে কর্মরত মাত্র একজন। জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসারের চার পদসহ আয়ুর্বেদিক মেডিকেল অফিসার পদ শূন্য। তবে সাধারণ রোগীদের সেবাদানে পটুয়াখালী হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী নার্সেরা দায়িত্ব পালন করছেন।

রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী চরম ভোগান্তিসহ কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রোগীদের অভিযোগ, ঠিক সময় ডাক্তার পাওয়া যায় না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সরকারি ওষুধ দেওয়া হয় না। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। ভর্তি রোগীদের তেমন কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না হাসপাতাল থেকে। এমনকি গজ, লিকোপ্লাস্ট, ডিসপোজাবল সিরিঞ্জ, তুলাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও পান না রোগীরা।

রাজবাড়ী প্রতিনিধি দেবাশীষ বিশ্বাস জানান, রাজবাড়ী আধুনিক সদর হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসাসেবা পাওয়া খুবই দুষ্কর। চিকিৎসক সংকট আর দক্ষ জনবলের অভাবে সেবা থেকে বঞ্চিত মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও মেলে না চিকিৎসকের দেখা। হাসপাতালেই মানা হয় না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অবস্থা আরও বেহাল। নানা সংকট নিয়েও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালসূত্রে জানা যায়, রাজবাড়ী ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ রেয়েছে ৪১টি। তার মধ্যে ২৬টিই শূন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই ১২ জন। হাসপাতালে পর্যাপ্ত নার্সের পদায়ন থাকলেও ১৩ জন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় এবং ২০ জন কভিড ইউনিটে কাজ করায় নার্সের সংকট তৈরি হয়েছে। ১২ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র তিনজন। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট না থাকায় চরম বিপাকে কর্তৃপক্ষ। কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাব। সদর হাসপাতালে নয় বছর ধরে নষ্ট আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম মনি জানান, চিকিৎসক ও জনবল সংকটে সাতক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা ঠিকমতো পাচ্ছেন না রোগীরা। অথচ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নড়াইল, যশোর, মাগুরাসহ আশপাশের বেশ কিছু জেলা থেকে প্রতিনিয়ত শত শত করোনা পরীক্ষার নমুনা পাঠানো হচ্ছে এই মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে। ৩০ জুন সন্ধ্যায় অক্সিজেন সংকটে এ হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউতে ছয়জনসহ দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে নয়জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

বর্তমানে সিনিয়র, জুনিয়র, সহকারী সার্জনসহ মোট ৫৮ পদের বিপরীতে ২৭ শূন্য পদ নিয়েই চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, হাতে গোনা তিন-চার জন ডাক্তার ছাড়া বাকিদের ঠিকমতো দেখা যায় না। অধিকাংশ সময় শহরের প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়ে তাদের ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ওয়ার্ডবয়, আয়াসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির লোকবলের অভাবে বাথরুমগুলো নোংরা ও আর্বজনায় ভরে থাকে। অব্যবস্থাপনা চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর প্রেসার ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে নার্সদের দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।

শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি দীপংকর ভট্টাচার্য জানান, ১৫ বছর ধরে নষ্ট হয়ে আছে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে মেশিন। নেই এক্স-রে টেকনিশিয়ান। সনোলজিস্ট না থাকায় অকেজো আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন। টেকনিশিয়ান না থাকায় ইসিজি মেশিনটিও অকেজো। শূন্য রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া) পদ। আউটডোর-ইনডোরে রয়েছে ডাক্তার সংকট। পর্যাপ্ত জনবল নেই প্যাথলজি বিভাগে। এতে ব্যাহত চিকিৎসাসেবা। জানা যায়, ২০১২ সালের ৩১ শয্যার জনবল দিয়েই এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যার কার্যক্রম চালু হয়। কিন্তু দীর্ঘ নয় বছরেও ৫০ শয্যার জনবলের নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়নি। বর্তমানে ৩১ শয্যার জনবলও এখানে নেই।

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি আবদুল লতিফ লিটু জানান, জেলায় হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। পিসিআর ল্যাব ও আইসিইউ না থাকায় ভোগান্তিতে এ জেলার জনগণ। নামে মাত্র আধুনিক সদর হাসপাতাল, বাস্তবে নেই তার কোনো ছোঁয়া।

ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে করোনা ইউনিট ঘুরে জানা যায়, করোনা রোগী ও অন্য সাধারণ রোগীরা একই রাস্তা ও একই টয়লেট ব্যবহার করায় অন্যরাও সংক্রমিত হচ্ছেন। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে ঠাকুরগাঁও জেলা। তার পরও নেই করোনা পরীক্ষার পিসিআর ল্যাব। আর আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউও নেই। করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা নিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নমুনা প্রদানকারীকে। রিপোর্ট প্রাপ্তির ধীরগতির জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির অজান্তেই অন্যরাও সংক্রমিত হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য দ্রুত করোনা পরীক্ষার পিসিআর ল্যাব স্থাপনের দাবি জেলাবাসীর।

এ ছাড়া আধুনিক সদর হাসপাতালসহ জেলার পাঁচ উপজেলায় নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স। কোনো প্রকার টেস্ট এসব হাসপাতালে হয় না। সব টেস্ট রোগীকে বাইরে থেকে করতে হয়। হাসপাতালের পরিবেশ অনেকটাই নোংরা। বলা যায়, জেলার হাসপাতালগুলোই রোগে আক্রান্ত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেন বেলাল জানান, হাসপাতালে নেই সিসিইউ বেড, হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা। তিন মাসেও শেষ হয়নি লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট নির্মাণকাজ। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে আধুনিক হাসপাতালে রোগীদের অবস্থা শোচনীয়। করোনা চিকিৎসায় চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ৩৫ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার ভরসাস্থল হাসপাতালটি বহু সমস্যায় কাতর। সরেজমিন দেখা গেছে, বাইরের লোকজন ওয়ার্ডে প্রবেশ করছেন। মেঝেতে ময়লা। নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। দীর্ঘদিন ধরে জেনারেটর বিকল থাকায় আইসোলেশন ও হাসপাতালে নির্ধারিত ওয়ার্ডের রোগীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর