শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

পিলারে ২৫ দিনে চার ধাক্কা অরক্ষিত পদ্মা সেতু

ষড়যন্ত্র কি না খতিয়ে দেখার পরামর্শ, সরানো হচ্ছে ফেরিঘাট

নিজস্ব প্রতিবেদক

পিলারে ২৫ দিনে চার ধাক্কা অরক্ষিত পদ্মা সেতু

ফেরির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পদ্মা সেতুর পিলার

মাত্র চার দিনের ব্যবধানে গতকাল পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে আবারও কাকলি নামের একটি ফেরির ধাক্কা লেগেছে। ৯ আগস্ট একই পিলারে সজোরে ধাক্কা দেয় রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর। এতে পিলারের পানির লাগোয়া অংশে (পাইল ক্যাপ) পলেস্তারা উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে ২৫ দিনের মধ্যে পদ্মা সেতুর পিলারে চারবার ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটল। এর আগে ২০ জুলাই ও ২৩ জুলাই সেতুর ১৬ ও ১৭ নম্বর পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগে। দেশের মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার ফেরির ধাক্কা লাগার বিষয়টিকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নিতে নারাজ সাধারণ মানুষ থেকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও। এ দুর্ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন খোদ সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

গতকাল পদ্মা সেতুর পিলারে আবার ফেরির ধাক্কা লাগার পর থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে ফেরি চলাচল আড়াই ঘণ্টা বন্ধ রাখে ঘাট কর্তৃপক্ষ। এতে চরম দুর্ভোগের শিকার হন উভয় পাড়ে অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। জানা গেছে, বারবার পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগায় বাংলাবাজার ফেরিঘাটটি সরিয়ে নেওয়া হবে। গতকাল অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, পদ্মা সেতু এলাকা এড়াতে বাংলাবাজার ফেরিঘাট স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এটি শরীয়তপুরের জাজিরায় মাঝিরকান্দি ঘাটে নেওয়া হবে। এতে এক দেড় মাস সময় লাগবে। গত জুলাইয়ে ১৭ নম্বর পিলারে শাহজালাল ফেরির ধাক্কার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ঘাট সরানোর সুপারিশ করা হয়। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও দেওয়া হয় পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে। তবে এ মুহূর্তে ফেরিঘাট সরানো পদ্মা সেতুর জন্য আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে জানান সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (নদীশাসন) মো. শরফুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ফেরিঘাট সরানো সময়সাপেক্ষ। এতে নদী শাসন ব্যাহত হবে। আর নদী শাসনের কাজ বিলম্বিত হলে পদ্মা সেতু ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

গতকাল দুর্ঘটনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার ফেরির ধাক্কাকে নিছক কোনো দুর্ঘটনা বা চালকের অদক্ষতা বলে এড়িয়ে যাওয়া ভুল হবে। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, অন্তর্ঘাত আছে কি না, তা তদন্ত করে দেখতে হবে। এই সেতু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এখনো পদ্মা সেতুর পেছনে লোক লেগে আছে। পদ্মা সেতু পুরো জাতির সম্পদ। উপস্থিত সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, শর্ষের মধ্যে ভূত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আগামী বছর জুনের মধ্যে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে সেতু।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার আঘাতে মানুষের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। এতে আমরা বিব্রত। ধাক্কার ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর পেছনে যাদের দায়িত্বহীনতা বা উদাসীনতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার কেন আঘাত লাগছে, এ নিয়ে গতকাল রাতে ঢাকার বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পদ্মা সেতু প্রকল্প, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকদের নিয়ে রাত ৮টায় বৈঠকটি শুরু হয়। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও কেবিনেট সচিব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠকটি চলছিল। বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, ২০ জুলাই প্রথম পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে রো রো ফেরি শাহ মখদুমের তলা ছিদ্র হয়ে যায়। ২৩ জুলাই মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছেড়ে আসা রো রো ফেরি শাহজালাল ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা দিলে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ১০ নম্বর পিলারে সজোরে ধাক্কা খায়। গতকাল একই পিলারে ধাক্কা দেয় ফেরি কাকলি। এসব ঘটনায় সেতুর পিলারের পানির লাগোয়া অংশে (পাইল ক্যাপ) পলেস্তারা উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঘাটসূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসেই তিনবার সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগে। ৬ জুলাই ফেরি গোলাম মওলা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয়। তবে প্রথম ধাক্কা ও ক্ষয়ক্ষতি তেমন না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি।

মাস্টার-সুকানি বরখাস্ত : পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেওয়া কাকলী ফেরির মাস্টার মো. বাদল হোসেন ও হুইল সুকানি আবদুর রশিদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বিআইডব্লিউটিসি। সঠিকভাবে ফেরি চালাতে না পারায় ওই দুজনের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম খান। তবে ফেরির মাস্টার মো. বাদল হোসেন বলেন, ফেরির ওপর নিয়ন্ত্রণ কম এবং পদ্মার তীব্র স্রোতে ফেরি কাকলি চালানো হলে সেতুর পিলারে ধাক্কা লাগতে পারে উল্লেখ করে গত ১১ আগস্ট বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের সহ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) বরাবর চিঠি দিয়েছিলেন তিনি। চিঠিতে বলা হয়, ফেরিটি মেকানিক্যাল (চেইন সুকান) হওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণ কম হচ্ছিল। এর কারণে পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা লাগতে পারে। তাই, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে না রেখে অন্য রুটে স্থানান্তর করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

সর্বশেষ খবর