শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

এহসান গ্রুপের মালিক রাগীব চার ভাইসহ গ্রেফতার

হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও পিরোজপুর প্রতিনিধি

এহসান গ্রুপের মালিক রাগীব চার ভাইসহ গ্রেফতার

দেশের অন্যতম নামকরা মাদরাসা হাটহাজারীতে পড়াশোনা করেছেন। খুলনার আরেকটি মাদরাসা থেকে পাস করে হয়েছেন মুফতি। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মসজিদে ইমামতির মাধ্যমে। তবে ইমামতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না রাগীব আহসান। ৯০০ টাকা বেতনে ঢাকার একটি এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি নেন। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন ‘এহসান গ্রুপ’। গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাসপাতাল, ক্যাডেট মাদরাসা, ট্রাভেল এজেন্সি বৃদ্ধাশ্রম, আবাসন কোম্পানিসহ মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নিজের তিন ভাই, বোন, তার শ্বশুর, বোনজামাইসহ নিকটাত্মীয়দের প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান রাগীব। ইতিমধ্যে তিনি প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার গ্রেফতার দাবিতে ভুক্তভোগীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধনও করেছেন। অবশেষে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০-এর একটি  দল গতকাল ভোরে রাজধানীর শাহবাগ এলাকার তোপখানা থেকে রাগীব ও তার সহযোগী আবুল বাশার খানকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে তার অন্য দুই ভাই মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মো. খাইরুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পিরোজপুরের খলিশাখালী নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দুজনকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই রাগীব অনেক বিষয় স্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে তার কোম্পানিতে যুক্ত করেন। ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন। এরই মধ্যে শতাধিক ভুক্তভোগী রাগীবের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন।

রাগীবের প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, লক্ষাধিক গ্রাহক তার মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা প্রতারিত হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা দাবি করেন, রাগীব তার প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে অর্থ সংগ্রহ করে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গাজমি কিনেছেন। এ ছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। শ্বশুরকে প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, বাবাকে প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতিকে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার করেছিলেন প্রতারক রাগীব।

র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, ‘সম্প্রতি এমএলএম কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। অনেকে র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ছায়াতদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াই। পরে তোপখানা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তিনি ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৯৬-১৯৯৯ পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদরাসা থেকে মুফতি সনদ নেন। পরে পিরোজপুরের একটি মাদরাসায় চাকরি শুরু করেন। ২০০৬-২০০৭ সালে ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে ‘এমএলএম’ কোম্পানির প্রতারণার বিষয়টি রপ্ত করেন। পরে ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি করেন। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির অপব্যবহার করে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করেন রাগীব। র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, রাগীব দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, মসজিদের ইমাম ও অন্যদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। তিনি ‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’-এর বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন। তা ছাড়া ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে ব্যবসায়িক প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। লাখ টাকার বিনিয়োগে প্রতি মাসে বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত লাভের প্রলোভন দেখাতেন। ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে তার কোম্পানিতে যুক্ত করেন। এখন গ্রাহকের সংখ্যা লক্ষাধিক বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতারক রাগীবের ৩ শতাধিক কর্মচারী রয়েছেন। যাদের কোনো ধরনের বেতন দেওয়া হতো না। তারাই মাঠপর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে দিতেন। এতে ২০ শতাংশ লভ্যাংশের প্রলোভন দেখাতেন। এভাবেই রাগীবের দ্রুত গ্রাহক বাড়তে থাকে। তবে বর্তমানে তিনি তার কর্মচারী, গ্রাহক সবাইকেই প্রতারিত করেছেন।

১৭টি প্রতিষ্ঠান : রাগীব আহসান প্রতারণার মাধ্যমে ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেগুলো হলো- এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি : রাগীব আহসান গ্রাহকের টাকা দিয়ে হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, মার্কেট-দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এ ছাড়া রাগীব আহসান সাধারণ গ্রাহককে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারিত করেছেন। অনেকে পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হতেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।

আরও দুই ভাই গ্রেফতার : পিরোজপুরের খলিশাখালীর নিজ বাড়ি থেকে রাগীব আহসানের আরও দুই ভাই মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মো. খাইরুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের গ্রেফতারের পর থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাওনা টাকার জন্য বিক্ষোভ করছেন ভুক্তভোগীরা। তারা বলছেন, তার পরিবারের সদস্যরা শতভাগ জড়িত। যখনই গ্রাহকরা টাকার দাবি নিয়ে বড় খলিশাখালী মাদরাসায় তার বাবার কাছে যেতেন তখনই তার পরিবারের সদস্যরা মিলে গ্রাহকদের মারধর করতেন। মাদরাসার শিক্ষক, ছাত্র, ইমাম, মুয়াজ্জিন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ কয়ের হাজার গ্রাহক থেকে হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান। পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আ জ মো মাসুদুজ্জামান জানান, পিরোজপুর শহরের ছোট খলিশাখালী থেকে অন্য দুই ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামিদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। বাকি আসামি শামীম খানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর