ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শহীদ মিনার ও দোয়েল চত্বর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। উভয় পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শহীদুল্লাহ হলের সামনে ড্রেনে ফেলে দুই নেতা-কর্মীকে পেটানোর অভিযোগ করেছে ছাত্রদল।
টিএসসিতে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে গতকাল সকালে শহীদ মিনারের সামনে এবং দ্বিতীয় দফায় বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে দোয়েল চত্বরের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। পরে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায় ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা। তবে তারা আবারও ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে, এ ধারণা থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। তাদের অনেকের হাতে স্টাম্প ও লাঠিসোঁটা দেখা যায়। এ ছাড়া ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীকে মোটরসাইকেলে পুরো ক্যাম্পাসে শোডাউন করতে দেখা গেছে।
ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাব এবং বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। তবে ঢাবি ছাত্রলীগ বলছে, ছাত্রদল কিলিং মিশন নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল।
ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের হামলায় তাদের অন্তত ২৫-৩০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। হকিস্টিক, রড, চাপাতি ও দেশি অস্ত্র নিয়ে অতর্কিত হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেন তারা। হামলার শিকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে আছেন ঢাকা মহানগর পূর্ব শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কর্মী আল-আমিন বাবলু। এর মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মিনহাজুলকে রিকশা থেকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের বক্তব্যের পর গত রবিবার সন্ধ্যায় টিএসসি এলাকায় ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই হামলার প্রতিবাদে ও জুয়েলের বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরতেই গতকাল সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে ছাত্রদল। সংবাদ সম্মেলনে আসার পথে তাদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দোয়েল চত্বর ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের সামনে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইট ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
ঢাবি ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর ছাত্রদল ক্যাম্পাস ছাড়লেও টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও মধুর ক্যান্টিনে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া মোটরসাইকেল শোডাউনও চলে। ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সব মোড়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। ছাত্রদলবিরোধী খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে তারা।
ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ক্যাম্পাসে বছরের পর বছর ধরে সহাবস্থান চলছে। ক্যাম্পাসে কী এমন হয়েছে, জঙ্গি মনোভাব নিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য লাঠিসোঁটা হাতে ঢুকতে হবে? আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলা হয়েছে, কার কী রাজনৈতিক পরিচয় সেটি আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়- ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে ভোরবেলা যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে। কী ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছেও প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।
কিলিং মিশন নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল ছাত্রদল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগ হামলা করেনি বরং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে ছাত্রদল। ছাত্রদল অছাত্র ও সন্ত্রাসীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিহত করে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ছাত্রলীগও ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। ছাত্রদল কিলিং মিশন নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল। ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে, ছাত্রদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তারা এখানে এসেছে।
শিক্ষাঙ্গনে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে ছাত্রলীগ : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায় ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)। গতকাল ইউট্যাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদ হাসান খান এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানান। এ ছাড়া ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ এনে প্রতিবাদ জানিয়ে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায় ছাত্র সমাজের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে ছাত্র ফেডারেশন। গতকাল ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড ও সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ এক যৌথ বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন।
বিক্ষোভসহ দুই দিনের কর্মসূচির ডাক ছাত্রদলের : নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে দুই দিনের বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ২৬ মে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) ও ২৭ মে সারা দেশের জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে সংগঠনটি। গত রাতে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ।
এ সময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল অভিযোগ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় ছাত্রদলের নারী নেত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৮০ নেতা-কর্মী আহত হন। এর মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন। ক্যাম্পাসে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালনের সময় ছাত্রলীগ হকিস্টিক, রড, রামদা, চাপাতি ও দেশি অস্ত্র নিয়ে এ হামলা চালায়।
জবি ছাত্রদলের মশালমিছিল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) ছাত্রদলকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে মশালমিছিল করেছে জবি ছাত্রদল। গত রাত ৮টার দিকে মিছিলটি ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে শুরু হয়ে রায়সাহেব বাজার মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে জবি ছাত্রদল সভাপতি প্রার্থী আরেফিন বলেন, ‘এ রকম মধ্যযুগীয় আচরণ ছাত্রলীগকে ছাড়তে হবে। কোনোভাবেই ছাত্রসমাজ ও দেশের মানুষ এমন বর্বর আচরণ সহ্য করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংগ্রামী সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাইফ মাহমুদ জুয়েল কথা দিয়েছিলেন ছাত্রদল নেতা-কর্মীর ওপর হামলা হলে পাশে থাকবেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। তারা কথা রেখেছেন। জবি ছাত্রদলও কর্মী হিসেবে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে এবং পাশে থাকবে।’
ছাত্রদলকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার কোনো অধিকার ছাত্রলীগের নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সহ্য করব না। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে কোনো যৌক্তিক দাবিতে মাঠে থাকব। রক্ত দিয়ে হলেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করব।’