ভার্চুয়াল গিফট দেওয়ার নামে গত ছয় বছরে লোপাট হয়েছে ৩৭৭ কোটি টাকা। প্রলোভনে ফেলে সাধারণ গ্রাহকদের থেকে এসব টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ‘রিং আইডি বিডি লিমিটেড’ ও ‘রিং আইডি ডিসট্রিবিউশন লিমিটেড’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান এমন প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকও একই ব্যক্তি।
৪ আগস্ট রাজধানীর গুলশান থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করা মামলাসূত্রে এসব জানা গেছে। মামলাটি করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) এসআই আল ইমাম। আসামি করা হয়েছে শরীফুল ইসলাম, তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম এবং ভাই সাইফুল ইসলামকে। এরা ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়েছেন।
সিআইডির অনুসন্ধান বলছে, রিং আইডি নামে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) করে। তারা অনলাইনে অল্প সময়ে বেশি অর্থ উপার্জনের লোভনীয় ও অস্বাভাবিক অফারের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। একই সঙ্গে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে ভার্চুয়াল গিফট দেওয়ার ব্যবস্থা করে এবং গ্রাহকদের অনলাইনে বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখিয়ে অল্প সময়ে বেশি উপার্জনের প্রলোভন দেখায়। এভাবে রিং আইডি মোবাইল অ্যাপস, মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট রিং আইডি বিডি লিমিটেডের এবং গত বছরের ৩০ জুন রিং আইডি ডিসট্রিবিউশনের যাত্রা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয়।
রিং আইডি বিডি ও রিং আইডি ডিসট্রিবিউশন পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। ব্র্যাক ব্যাংকের পান্থপথ শাখা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখা ও উরী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় রিং আইডি বিডি লিমিটেডের নামে এবং রিং আইডি ডিসট্রিবিউশন লিমিটেডের নামে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখায় থাকা অ্যাকাউন্টে ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৭৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে ৩০২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের ব্যাংকে টাকা জমানোর ক্ষেত্রে টাকার উৎস দেখিয়েছে এজেন্ট, ব্র্যান্ড প্রমোটার নিয়োগ ও ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের গিফট কেনার মূল্য বাবদ।
সিআইডির ভাষ্য, রিং আইডি কর্তৃপক্ষ ‘কমিউনিটি জব’ নামে একটি বিশেষ সেবা চালু করে। এতে বলা হয়, শুধু বিজ্ঞাপন দেখেই টাকা আয় করা যায়। এজন্য তারা এজেন্ট ও ব্র্যান্ড প্রমোটার (যারা কমিউনিটি জবসের মাধ্যমে আইডি কিনে টাকা আয় করে) নিয়োগ করে। এ ছাড়া এজেন্টরা রিং আইডির অফিশিয়াল প্রতিনিধি হিসেবে ব্র্যান্ড প্রমোটার নিয়োগ করলে কমিশন পায়। আর রিং আইডি কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোনো আয় নেই। তারা অল্পসংখ্যক গ্রাহককে প্রথম দিকে টাকা ফেরত দিলেও তা দিয়েছে সেই গ্রাহকদের টাকা থেকেই। অর্থাৎ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা পঞ্জি স্কিমের মতো অর্থাৎ জনগণের টাকা দিয়েই জনগণের পাওনা দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ৪ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু রিং আইডি কর্তৃপক্ষ কোনো লাইসেন্স না নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে প্রতারণা করে আসছিল। এদিকে রিং আইডি অ্যাপে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরমে ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে এক ধরনের ভার্চুয়াল কয়েন বেচাকেনা হয়। এটি পরিচালনার জন্যও তাদের কোনো অনুমোদন নেই।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ভাটারা থানায় এবং যশোরের কোতোয়ালি থানায় শরীফুল ইসলাম, আইরিন ইসলাম ও সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়। এ দুটি মামলার পরই সিআইডির সিপিসি অনুসন্ধানে নামে।
সংস্থাটি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখে, রিং আইডি বিডি লিমিটেড ও রিং আইডি ডিসট্রিবিউশন লিমিটেডের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বড় অঙ্কের লেনদেন ও ভিন্ন ভিন্ন লেয়ারে তিনটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে অবৈধভাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। কোম্পানি তিনটি হলো- শান্তা সিকিউরিটিজ, আরএনআই সিকিউরিটিজ ও ভার্টেক্স স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড। এ ছাড়া আইপি ভিশন টেকনোলজি লিমিটেড, নেচারস্ক্যাপ লিমিটেড, আদরড স্টেট ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, আদরড ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং রিভেরি ইঞ্জিনিয়ার্স নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ঘুরেফিরে শরীফুল ইসলাম, আইরিন ইসলাম, সাইফুল ইসলাম এবং তাদের আত্মীয়স্বজন। এভাবে মোট ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা দেশের মধ্যেই লন্ডার করেছেন।
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলছেন, এ টাকা কোথায় কোথায় গেছে তা প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধানে জানা গেছে। আর বাকিগুলো কীভাবে কী হয়েছে তা মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসবে। সিআইডির অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, রিং আইডি কমিউনিটি জবসে গ্রাহকরা অনলাইনে বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখার মাধ্যমে গুগল অ্যাডসেন্স থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেছে, কিন্তু ওই টাকা রিং আইডির বাংলাদেশি অ্যাকাউন্টে আসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও রেমিট্যান্স হিসেবে আসার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ওইসব টাকা দেশে না এনে অবৈধভাবে বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।