বাংলা সংগীতের বিস্তীর্ণ ভুবনে কিছু মানুষ আছেন, যারা শুধু শিল্পী নন, তারা একই সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং গবেষণার ধারক ও বাহক। ড. মুস্তাফা জামান আব্বাসী তেমনই একজন কৃতী সংগীতজ্ঞ, যিনি একাধারে গায়ক, সুরকার, লেখক, সংগ্রাহক, গবেষক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তাবিদ। কিন্তু ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া ৮৯ বছর বয়সি এ সংগীতসাধকের জীবনাবসান ঘটে গতকাল ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে বনানীর ইয়র্ক হাসপাতালে। এ সংগীতজ্ঞের মেয়ে শারমিনী আব্বাসীর বরাতে জানা যায়, বেশ কিছু দিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। সর্বশেষ শুক্রবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিলেন। তবে শেষরক্ষা আর হয়নি, চিরবিদায় নিলেন এ গুণী ব্যক্তিত্ব।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন সংস্কৃতির গভীরে বসবাস করা মানুষ। পিতা ছিলেন কিংবদন্তি লোকসংগীতশিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ। তিনি বাবার আদরের ছোট ছেলে। সংগীতের হাতেখড়ি বাবার কাছেই। ছোটবেলা থেকেই সংগীত তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। পরে পাকিস্তানের বিখ্যাত উস্তাদদের কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নেন, যা তাঁর সংগীতজীবনের ভিত মজবুত করে। তাঁর চাচা আবদুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি গানের শিল্পী। তাঁর বোন ফেরদৌসী রহমান উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী। বড় ভাই মোস্তফা কামাল ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামাল সুপরিচিত একজন নজরুল সংগীতশিল্পী। তাঁর স্ত্রী আসমা আব্বাসী একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও লেখিকা ছিলেন, যিনি গত বছর মারা যান। তাদের দুই মেয়ের মধ্যে সামিরা আব্বাসী প্রকৌশলী। আর শারমিনী আব্বাসী একজন আইনজীবী। সংগীতশিল্পী ও লেখক হিসেবেও পরিচিতি আছে দুই বোনের।
তবে আব্বাসী নিজেকে কেবল একজন গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেননি। সংগীতকে তিনি দেখেছেন একটি সমাজসচেতন শিল্পরূপ হিসেবে, যার প্রতিটি সুর, শব্দ ও ব্যঞ্জনায় লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক চেতনা। তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বাংলা সংগীতের দলিল সংরক্ষণে, বিশ্লেষণে ও প্রজন্মান্তরে তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে। এ পর্যন্ত তিনি ৫০টিরও বেশি বই রচনা করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘আব্বাসউদ্দীন স্মারকগ্রন্থ’, ‘নজরুলগীতি পরিচিতি’, ‘বাংলা গানের কাহিনী’ ইত্যাদি। এসব গবেষণামূলক কাজ বাংলা সংগীতের জগতে এক বিরল সংযোজন। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে লোকসংগীত, নজরুলগীতি ও বাংলা আধুনিক গানের শৈলী, প্রভাব ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। তাঁর সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার লোকগান। তিনি ২৫টির বেশি দেশে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, নজরুলগীতি পরিবেশন করে বাংলাদেশের সংগীতকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে। তিনি ছিলেন ইউনেসকোর বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতি, নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের ইংরেজি জীবনী লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত গবেষক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপনায় প্রচারিত ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘আপন ভুবন’, ‘গানের কথা, গানের গল্প’ ছিল সংগীতপ্রেমীদের জন্য এক দুর্লভ প্ল্যাটফর্ম। গানের সঙ্গে গাথা ইতিহাস, কবির ভাবনা এবং সংগীতের রচনা পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে তিনি সেই অনুষ্ঠানে এনে দেন একাডেমিক ধারাও। এ অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে ভূষিত হওয়া একুশে পদকসহ বিভিন্ন সময় বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে পুরস্কারের চেয়েও বড় তাঁর অবদান-বাংলা সংগীতের নানা ঘরানাকে পরম যত্নে লিপিবদ্ধ করা এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সমাজসেবায়ও তিনি ছিলেন সক্রিয়, রোটারি ক্লাবের গভর্নর হিসেবে বহু উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আজ যখন বাংলা সংগীত বাজারমুখী হয়ে উঠছে, তখন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংগীত কেবল বিনোদন নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের গভীর প্রতিচ্ছবি। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, একটি জাতির সংগীতচর্চা কেবল কণ্ঠসাধনা নয়, বরং একটি চেতনাসাধনা।