পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ হলো ‘মা’। মায়ের মতো আপন কেউ নেই দুনিয়ায়। তাই মাকে কেন্দ্র করে বিশ্বে চলচ্চিত্র, গান, নাটক প্রচুর নির্মাণ হয়েছে এবং দর্শকহৃদয় কেড়েছে। ‘আজ বিশ্ব মা দিবস’। এ উপলক্ষে বিশ্বে মাকে ঘিরে নির্মিত সেরা কয়েকটি চলচ্চিত্রের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
আম্মাজান (১৯৯৯) : ঢাকায় নির্মিত ‘মা’ কেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’। নিজের সম্ভ্রমহানির পর মা হতবিহ্বল হয়ে যান, ছেলে বাদশা এ কষ্ট সইতে পারে না। মাকে সে নানা উপায়ে সুখী করতে চায়, তারপর ঘটতে থাকে নানা ঘটনা, জড়িয়ে পড়েন বিবাদে। এ ছবিতে একজন মাতৃপাগল সন্তানের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। নামভূমিকায় ছিলেন শবনম, আর সন্তান চরিত্রে প্রয়াত নায়ক মান্নার অভিনয় ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সম্পদ। দর্শকদের কাছে তিনি অন্তত এ ছবির জন্য অমর হয়ে থাকবেন। প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘আম্মাজান’ গানটি এখনো বেশ জনপ্রিয়, বেশ কয়েকটি শাখায় জাতীয় পুরস্কারও পায় ছবিটি।
মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭) : মাদার ইন্ডিয়া ভারতীয় মহাকাব্যিক নাট্য চলচ্চিত্র। এটি পরিচালনা করেছেন মেহবুব খান। অভিনয় করেছেন নার্গিস, সুনীল দত্ত, রাজেন্দ্রকুমার, রাজকুমার প্রমুখ। ছবির রাধা (নার্গিস) নামে এক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামের নারীর গল্প, যিনি তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতিতে ছেলেদের লালনপালন এবং ধূর্ত ধনদাতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। ব্যয়বহুল হিন্দি চলচ্চিত্র মাদার ইন্ডিয়া বর্তমানেও সর্বকালের ভারতীয় বক্স অফিসে হিট ছবির মধ্যে রয়েছে। এটি ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে মুক্তি পায়। ১৯৫৭ সালে শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য অল ইন্ডিয়া সার্টিফিকেট অব মেরিট এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছে, যেখানে নার্গিস এবং মেহবুব খান যথাক্রমে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে পুরস্কার জিতেছিলেন। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয়।
টু উইমেন (১৯৬০) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় কুঁকড়ে যাওয়া মানবতার করুণ গাথা সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে এনেছিলেন ইতালীয় নির্মাতা ভিত্তোরিও ডি সিকা। আলবার্তো মোরাভিয়ার লেখা ‘টু উইমেন’ উপন্যাসকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাওয়া এক মা শত্রুশিবিরের লালসা থেকে নিজের মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের সংগ্রামের সব কিছুই ‘টু উইমেন’-এ উঠে আসে। অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন অভিনয় করেছিলেন এ সিনেমায় মা সেসিরার ভূমিকায়। এ চরিত্রে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় তাঁকে এনে দিয়েছিল অস্কারসহ মোট ২২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আজও সেলুলয়েডে সন্তানকে বাঁচাতে মায়ের সংগ্রামের অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে অমর হয়ে আছে ১৯৬০ সালের এ সিনেমাটি।
মম (২০১৭) : বলিউড অভিনেত্রী প্রয়াত শ্রীদেবীর ৫০ বছরের অভিনয়জীবনে ‘মম’ অন্যতম সফল ছবি। এ ছবি তাঁকে জাতীয় পুরস্কারও এনে দিয়েছে। ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সংগীতকার এ আর রহমান। এ ছবির প্রযোজক হলেন শ্রীদেবীর স্বামী বনি কাপুর। তাঁর কথায় ‘মম’ এমন একটি ছবি যেটি এ বিশ্বের সব মা ও সিনেমাপ্রেমী ছবিটির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারবেন। এটিই প্রয়াত শ্রীদেবী অভিনীত শেষ ছবি। ২০১৭ সালের ৭ জুলাই মম মুক্তি পায় এবং বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
জুনো (২০০৭) : জ্যাসন রেইটম্যানের পরিচালনায় এ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র জুনো নামের এক কিশোরী। দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার পর মা হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা, সামাজিক ও পারিবারিক জটিলতা এবং অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচলে এগিয়ে চলা জুনোর গল্প নিয়ে নির্মিত হয় এ চলচ্চিত্র। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটি বক্স অফিসে ঝড় তোলে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন এলেন পেজ।
হাজার চৌরাসি কা মা (১৯৯৮) : সত্তর দশকের কলকাতা। নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেলে হারানো এক মায়ের মর্মস্পর্শী গল্প লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, তাঁর ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে। সেই গল্প থেকেই ভারতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় ‘হাজার চৌরাসি কা মা’। শোকাহত সেই মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়া বচ্চন। কলকাতায় ষাট থেকে আশি দশকের মধ্যে বামপন্থি নকশালদের আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিল এ রকম অসংখ্য তরুণ। গুমোট এ পরিস্থিতির বেদনাবহুল প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়েছিল জয়া বচ্চনের সুজাতা চ্যাটার্জি চরিত্রটিতে। সিনেমাটি জিতে নিয়েছিল ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
দ্য ব্লাইন্ড সাইড (২০০৯) : ২০০৯ সালে মার্কিন পরিচালক জন লি হ্যানকক এটি পরিচালনা করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক মাইকেল লুইসের একটি উপন্যাস থেকে সিনেমাটির চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়। দ্য ব্লাইন্ড সাইডে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে জয় করে কৃষ্ণাঙ্গ শিশু মাইকেলকে স্থানীয় একটি স্কুলের ফুটবল ক্লাবে ভর্তির ব্যবস্থা করেন তার বাবার বন্ধু। সেখানে এক শ্বেতাঙ্গ সতীর্থের সঙ্গে মাইকেলের সখ্য হয়। ওই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটির মা মাতৃস্নেহে মাইকেলের পাশে দাঁড়ান। দ্য ব্লাইন্ড সাইডের পটভূমি মূলত আমেরিকান সমাজের অন্যতম বড় সমস্যা বর্ণবাদ নিয়ে। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে বর্ণবাদ জয় করার একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে সিনেমায়। ২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে তৈরি সিনেমাটি মুক্তির বছরেই ৩০ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ব্যবসা করে। অর্জন করে বেশ কিছু পুরস্কার।
উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩) : শ্রেণি বৈষম্য ও সংগ্রামের এক করুণ চালচ্চিত্র হিসেবেই নির্মাতা অসিত রায় পরিচালনা করেছেন তাঁর ‘উত্তর ফাল্গুনী’ চলচ্চিত্রটি। যেখানে নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। দ্বৈত চরিত্রে তিনি ছিলেন একজন মা, আবার একই সঙ্গে সেই মায়ের সন্তানও। দারিদ্র্য, নিপীড়নের হাত থেকে শুধু মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মদ্যপ স্বামীর আশ্রয় থেকে। হয়ে যান পরপুরুষের বিনোদনের খোরাক এক বাইজি। ষাটের দশকে কলকাতার প্রেক্ষাপটে এমন এক গল্প সাড়া ফেলে দিয়েছিল সর্বত্র। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা বাংলা সিনেমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমা।
শুভদা (১৯৮৬) : মদ্যপ হারানের বউ শুভদা, সংসারে রয়েছে দুটি মেয়ে আর অসুস্থ পুত্রসন্তান। এর মধ্যে বড় মেয়ে ললনা বিধবা। সংসারের দিকে সেভাবে খেয়াল রাখে না হারান, সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে দায়িত্ব পালন করতে হয় শুভদাকেই। স্নেহময়ী বলেই পাশের বাড়ির সদানন্দ মাতৃরূপে দেখেন। এক দিন বড় মেয়ে হারিয়ে যায়, পুত্র মাধব মারা যায়। শুভদা কি এত শোক সইতে পারবে? অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘শুভদা’। নামভূমিকায় অভিনয় করেন আনোয়ারা। এ ছাড়া ছিলেন রাজ্জাক, গোলাম মুস্তফা, জিনাতসহ অনেকে। ছবিটি রেকর্ডসংখ্যক ১৩টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
মাতৃত্ব (২০০৪) : স্বামী চোর, সংসারে সে উদাসীন। স্ত্রী সখিনা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে সন্তানসম্ভবা হয়। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে পরম স্নেহে সন্তান পালনের। ভবিষ্যতের চিন্তায় সে অর্থ জমাতে থাকে। সেই অর্থের দিকে চোখ পড়ে স্বামীর। এক দিন সেই টাকা জোর করে নিয়ে যায় চোর স্বামী,
সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পেটে লাথি পাড়ে, তারপর। এ কাহিনি নিয়েই ২০০৪ সালে জাহিদ হোসেন নির্মাণ করেন ‘মাতৃত্ব’। মৌসুমীর ক্যারিয়ারে এটি অন্যতম সেরা ছবি, পাশাপাশি স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি।