পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রভাবে এশিয়ার অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের শঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার, খাদ্যবাজার ও মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান, চীন, জাপানের শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত এক মাসে অব্যাহতভাবে কমেছে জাপানি ইয়েন, ভারত ও পাকিস্তানের রুপির দর। একইভাবে এক মাস আগে আমেরিকার আরোপিত অতিরিক্ত শুল্পের কারণে চীনের অর্থনীতিতেও কিছুটা শ্লথগতি বিরাজ করছে। এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যে ধস শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শেয়ারবাজারের সূচক নামতে নামতে তলানিতে ঠেকেছে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ করেছেন। তবুও বাজারের অচলাবস্থা কাটেনি। বাংলাদেশের বাজারে খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি আবারও ঊর্ধ্বমুখিতার দিকে উঠছে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বাড়ছে। গত ২ এপ্রিল সংস্থাটির প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত এপ্রিলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতেও এই ঊর্ধ্বমুখিতা বিরাজ করতে পারে। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে এ অঞ্চলের খাদ্য পরিস্থিতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যুদ্ধবিগ্রহ সব সময় খাদ্যপণ্যের দামে প্রভাব ফেলে। তবে সবার আগে জ্বালানি ও শেয়ারবাজারে ধস নামায়। যার সামগ্রিক আঘাত পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক গম উৎপাদন ৭৯৫ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছাবে; যা ২০২৪ সালের সমান। যদিও একই সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের চাহিদাও বেড়েছে।
এতে গরিব এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের (ঢাকা কার্যালয়) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এর প্রভাব হবে অনেক লম্বা। যদিও দুই দেশ যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এটা অবশ্যই স্বস্তিদায়ক পুরো বিশ্বের জন্যই। কেননা যুদ্ধ বাড়লে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বাড়বে। এতে যুদ্ধের অংশ না হয়েও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে প্রতিবেশী দেশগুলো।
একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বা সার্বিকভাবে কী কী সমস্যা হবে- তা নিয়ে আগে থেকেই হোমওয়ার্ক করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া প্রভাব মোকাবিলার সম্ভাব্য কৌশল কী হতে পারে তা-ও ঠিক করে রাখার কথা বলেছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তানের এই যুদ্ধ অনিশ্চয়তায় ভরা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরেক নতুন অনিশ্চয়তা যোগ হলো।
ডিজিটাল মার্কেটিং ও ডিজিটাল অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের উচিত হবে খুবই কৌশলীভাবে নিজেদের পরিকল্পনা তৈরি করা। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান এ অঞ্চলের পরাশক্তিধর দুটি দেশ। একইভাবে দুই দেশের অর্থনীতিও বেশ বড়। যদিও ভারত জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে অনেক বড়। কিন্তু পাকিস্তানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ফলে দুই দেশই যদি মারমুখী অবস্থানে থাকে তবে পুরো এশিয়ার অর্থনীতিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
অবশ্য সবশেষ গতকাল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান। এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক রাফিউদ্দিন বলেন, এটা খুবই ইতিবাচক যে, তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) শুক্রবার (২ এপ্রিল) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, গম, চাল, মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যসূচক ১ শতাংশ বেড়েছে। এফএওর খাদ্য মূল্যসূচক এপ্রিল মাসে দাঁড়িয়েছে ১২৮.৩ পয়েন্টে। মার্চ মাসে যা ছিল ১২৭.১। অর্থাৎ মাসিক ভিত্তিতে সূচকটি ১ শতাংশ বেড়েছে। তবে ২০২২ সালের মার্চে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যতটা উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তার তুলনায় এখনো ১৯.৯ শতাংশ কম।
রপ্তানি কমে যাওয়ায় রাশিয়ার গমের সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে। অন্যদিকে চালের দাম বেড়েছে বিশ্বব্যাপী চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টার মজুতও কমে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে শস্য মূল্যসূচক বেড়েছে ১.২ শতাংশ। যা আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় সূচকটির প্রবৃদ্ধি ০.৫ শতাংশ কম।
এপ্রিল মাসে মাংস মূল্যসূচক বেড়েছে ৩.২ শতাংশ। শূকরের মাংসের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে গরুর মাংসে আমদানি চাহিদা বেড়েছে। দুগ্ধজাত পণ্যের মূল্যসূচক বেড়েছে ২.৪ শতাংশ, যা এক বছরে বেড়েছে ২২.৯ শতাংশ। ইউরোপে মাখনের মজুত হ্রাস পাওয়ায় রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে এ পণ্য। অন্যদিকে পাম তেলের দাম কমে যাওয়ায় উদ্ভিজ্জ তেলের মূল্যসূচক কমেছে ২.৩ শতাংশ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তার প্রভাবে চিনির দাম কমেছে ৩.৫ শতাংশ।