খুলনার এরশাদ শিকদারের কথা মনে আছে? ’৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত খুলনায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এরশাদ শিকদার। ভূমি দখল, মানুষ হত্যা, ভয়ভীতি দেখিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল খুলনা শহরজুড়ে। এরশাদ শিকদারের কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে গেলেও কুমিল্লার লাকসামের মানুষ ভোলেনি। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা লাকসামে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তাজুল ইসলাম এবং তার লোকজন। তাজুল ইসলামকে স্থানীয় লোকজন লাকসামের এরশাদ শিকদার বলে অভিহিত করত। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলত না। লাকসামে শুধু দুর্নীতি নয়, মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি দখল, টর্চার সেন্টারে নিয়ে মানুষকে নির্যাতন করে জমি লিখে দিতে বাধ্য করা এবং বহু মানুষকে গুম করে দেওয়ার অভিযোগ আছে সাবেক আওয়ামী লীগের এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এখন আওয়ামী লীগের পতনের পর লাকসামবাসী তার বিরুদ্ধে মুখ খুলছে। আর এসবে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
১৯৯৬ সালে এমপির পদে বসেই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে তাজুল বিস্তার করতে থাকেন নিজের সাম্রাজ্য। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাজুল। নিজেকে ভাবতে শুরু করেন লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার একক অধিপতি। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে দাবিয়ে রাখার কূটকৌশল নেন সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। দিন যত গেছে, তাজুলের নিজ আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের হাইব্রিড নেতাদের দিয়ে দল পরিচালনার পরিধি ততই বেড়েছে। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলজিআরডিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তাজুল। তখনই অহঙ্কার ও দম্ভের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছান তিনি। মন্ত্রিত্ব পেয়েই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজ নির্বাচনি এলাকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলের নেতা-কর্মীদেরও আর প্রয়োজন বলে মনে করেননি। তিনি বনে যান লাকসাম-মনোহরগঞ্জের অঘোষিত সম্রাট।
তাজুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হওয়ার পর এখানে ‘তাজুলীগ’ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সেটি প্রতিষ্ঠিতও হয়। ‘তাজুলীগ’ ছাড়া তার কাছে আর কারও মূল্য ছিল না। দানবীয় প্রকৃতির তাজুল ইসলাম দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর তার রাক্ষুসে ভাব স্বরূপে আবির্ভূত হয়। নজর পড়ে লাকসামের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের ওপর। ২০১০ সালে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে লাকসাম সমবায় ব্যাংকের গ্রাহকদের সঞ্চিত টাকায় কেনা স্থাবর-অস্থাবর শতকোটি টাকার সম্পদ দখল করে নেন তাজুল ইসলাম। দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে, লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানি ডিক্রিজারি মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড। এরপর ওই ব্যাংকের স্থাবর সম্পত্তির নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। ওই নিলাম বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে তৎকালীন লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নিলাম কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য সমবায় ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়ে একটি চিঠি দেন। কিন্তু ওই চিঠির গুরুত্ব না দিয়ে লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্তে অটল থাকে। স্থানীয়দের দাবি, তৎকালীন এমপি তাজুল ইসলামের সমবায় ব্যাংকের সম্পত্তি দখলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যানের চিঠির গুরুত্ব দেয়নি। লাকসাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে বিক্রি হয়। নিলামে তাজুল ইসলাম সন্ত্রাসী বাহিনীদের দিয়ে মহড়া করে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ওই নিলামে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি।
সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের পাঁচ খলিফার তাণ্ডবে আওয়ামী লীগের পুরোটা সময় তটস্থ ছিল লাকসাম ও মনোহরগঞ্জবাসী। আয়নাঘর বানিয়ে নির্যাতন করে টাকা আদায়, টেন্ডারবাজি ও জোরজুলুম করে জমি দখলসহ নানাভাবে হয়রানি করাই ছিল তাদের কাজ। এসব অনৈতিক কাজে নেতৃত্ব দিতেন মন্ত্রীর ভাতিজা সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন, ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মো. কামাল হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও মন্ত্রীর শ্যালক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত আলী। অনৈতিক কাজ করে তারা এখন বিশাল সম্পদের মালিক।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, তাজুল ইসলাম এমপির পদে বসেই বিস্তার করতে থাকেন নিজের সাম্রাজ্য। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। নিজেকে ভাবতে শুরু করেন লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার একক অধিপতি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে দাবিয়ে রাখার হোলিখেলায় মেতে ওঠেন তিনি। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলজিআরডি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। এরপর অহংকার ও দম্ভের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছান তিনি। লাকসাম-মনোহরগঞ্জের সম্রাট যেন তিনিই। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাজুল লুটপাট আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের খেলায় মেতে ওঠেন। দেশ-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। দুর্নীতি, অনিয়ম ও সীমাহীন ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তিনি। মনোহরগঞ্জে বিগত আওয়ামী শাসনামলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ভাতিজা সাবেক যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন। এলাকায় মন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। চাচা মন্ত্রী হওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ মানুষকে তুলে নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ সম্পদের পাহাড় গড়তে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। গত ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে নির্বাচিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন প্রার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে মোট ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ১১ জন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সর্বমোট ৩৩ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে মন্ত্রীর ভাতিজা আমির। এলজিইডির প্রতিটি কাজে ১০ শতাংশ হারে কোটি কোটি চাঁদা নিতেন ওই আমির। বর্তমানে তার নামে যমুনা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে। বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের শ্যালক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত আলীর কোনো মহব্বত নেই। নানা অপরাধমূলক কর্মের জন্য এলাকায় তিনি কসাই হিসেবে পরিচিত। কুমিল্লা জেলার লাকসাম শহরের প্রাণকেন্দ্র থানার সামনেই ছিল তার ব্যবসায়িক অফিস। জেলায় এটি আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত। এ ঘর থেকেই লাকসামে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের নির্দেশ দেওয়া হতো। মহব্বতের ছিল দুই খলিফা। চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন শামীম ও চেয়ারম্যান ওমর ফারুক। তাদের গোবিন্দপুর ও কান্দিরপাড়ে ছিল আয়নাঘরের দুটি শাখা। আরও দুটি শাখা পরিচালনা করতেন লাকসাম পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনসুর আহমদ মুন্সী ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু ছায়েদ বাচ্চু। বাচ্চুর পশ্চিমগাঁও পুরান বাজারের বাসা ও রাজঘাটে মুন্সীর কার্যালয়ে ছিল আয়নাঘরের জল্লাদখানা। আয়নাঘরের প্রধান কার্যালয় থেকে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী প্রতিদিন চারটি শাখা থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। এসব করে টোকাই মহব্বত আলী রাতারাতি হয়ে যান গাড়ি, বিশাল অট্টালিকা ও নামেবেনামে অঢেল সম্পদের মালিক। এসব আয়নাঘরে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদেরও নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। নির্যাতিত লাকসামবাসী এসব নির্যাতনের বিচার চান। ২০১২ সালে শ্যালক মহব্বতকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেন তিনি। যদিও ওই সময় ধনসম্পদ বলতে মহব্বতের তেমন কিছু ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, ধীরে ধীরে তৈরি হয় মহব্বতের গুন্ডা বাহিনী। তারা রেলওয়ের জায়গাসহ বিভিন্ন সরকারি জায়গা দখল করতে থাকে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে কৌশল পাল্টে তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করেন মহব্বত। ২০১৮ সালে তাজুল ইসলাম স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এ সময় একক রাজত্ব শুরু হয় মহব্বতের। প্রশাসনের প্রতিটি দপ্তরে তার প্রভাব ছিল। শুরু করেন প্লট-বাড়ির ব্যবসা। গত ১০ বছর লাকসামে অন্তত ৭০টি পুকুর ভরাট করেন তিনি। বাদ যায়নি ফসলি জমিও, যা প্লট আকারে বিক্রি করতেন। সম্প্রতি ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কুমিল্লার লাকসাম পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও দৈনিক দিনকাল পত্রিকার লাকসাম প্রতিনিধি মনির আহমেদ। একই অভিযোগে আরও অজ্ঞতা ৯০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় অন্যান্য আসামির মধ্যে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে তার শ্যালক লাকসাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী, পৌর কাউন্সিলর মোহাম্মদ উল্লাহ, বিপুলাসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, লাকসাম পৌর মেয়র অধ্যাপক আবুল খায়ের, গোবিন্দপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন শামীম, কান্দিরপাড় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক, কাউন্সিলর খলিলুর রহমান, মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও মন্ত্রীর ভাতিজা আমিরুল ইসলাম, মন্ত্রী তাজুলের উন্নয়ন সমন্বয়কারী কামাল হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, আজকরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, রুহুল আমিন, আবদুল কাদের শাহীন ও কাওছার আহমেদ। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আরও একাধিক মামলা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার পর লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায়ও মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ জনতা মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও গ্রামে অবস্থিত তাজুলের আলিশান বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এরপর অগ্নিসংযোগ করা হয় পুরো বাড়িতে। লুটপাট করে নেওয়া হয় বাড়ির সব মালামাল। একই সময়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে লাকসামের পাইকপাড়ায় অবস্থিত তাজুলের আরেকটি বাড়িতেও। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতাসহ সাধারণ মানুষ বলতে থাকে, দীর্ঘ দেড় যুগ পর জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা। এতদিন নিজেকে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের প্রভু ভাবতেন তাজুল। সেই সঙ্গে অবসান ঘটে তাজুলের অহঙ্কার ও দম্ভেরও। ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে (৫ আগস্ট) দেশত্যাগ করলেও তাজুল দেশের পরিস্থিতি টের পেয়েছেন আরও আগেই।