আশুরা—হিজরি সনের প্রথম মাস, মহররমের দশম দিন—ইসলামী ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনটি ঘিরে পুরো মুসলিম বিশ্বে আবেগ, ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতা জড়িয়ে আছে। কালের পরিক্রমায় এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারী মুমিনদের ফেরাউনের জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। বিপরীতে ফেরাউন ও তার সশস্ত্র বাহিনী নীল নদে (বা লোহিত সাগরে) চিরতরে নিমজ্জিত হয়।
তাই আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা (আ.) এই দিনে রোজা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে রাসুল (সা.)ও এই দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দেন। তাই সুন্নি মুসলমানদের কাছে আশুরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের দিন হিসেবে বিবেচিত, যেদিন রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ। অন্যদিকে শিয়া মুসলিমদের দৃষ্টিতে আশুরা এক শোকাবহ স্মৃতির দিন।
৬১ হিজরির এই দিনে কারবালার প্রান্তরে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন রাসুল (সা.)-এর প্রিয় নাতি হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের প্রায় ৭২ জন সদস্য।
তাই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশুরার দিন শিয়ারা বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গভীর শোক পালন করে থাকে। এই উপলক্ষে হাজার হাজার শিয়া নবীজি (সা.)-এর পরিবারের সদস্যদের মাজার ও সমাধিস্থলসমূহে সমবেত হন এবং কারবালার শহীদদের স্মরণে শোকসভা ও নানা আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইরাকে বসবাসরত শিয়া মুসলমানদের মধ্যে আশুরার প্রাক্কালে কারবালায় পায়ে হেঁটে যাত্রা করার একটি প্রচলন আছে।
তাঁরা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে হুসাইন (রা.)-এর পবিত্র রওজায় যান, যেখানে বিশাল শোক মিছিল ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন ধরনের কালো পোশাক পরে, কেউ কেউ কাফনের মতো সাদা কাপড় জড়িয়ে নেন। তাঁরা বুকে ও মুখে হাত দিয়ে আঘাত করে শোক প্রকাশ করেন। অনেকেই পতাকা ও ব্যানার বহন করেন, যেগুলোর মাধ্যমে হুসাইন (রা.)-এর আদর্শ ও ত্যাগের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় বলে মনে করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ করে কট্টর ও চরম আবেগপ্রবণ একটি গোষ্ঠী ধারালো বস্তু কিংবা শিকল দিয়ে নিজেদের শরীর আঘাত করে থাকেন।
তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এভাবে রক্ত ঝরিয়ে তাঁরা কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করেন এবং ইমাম হুসাইনকে সমর্থন করতে না পারার জন্য অনুশোচনার প্রকাশ ঘটান। এই আচারগুলো শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগ ও ঐতিহাসিক বেদনার বহিঃপ্রকাশ, যা প্রতিবছর আশুরার দিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দৃশ্যমান হয়।
আশুরার দিনে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো নানা ধরনের ধর্মীয় ও আবেগনির্ভর আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। পুরুষদের জন্য মসজিদ, ঈদগাহ কিংবা কমিউনিটি হলগুলোতে অনুষ্ঠিত হয় তথাকথিত ‘কিরাত’ এক ধরনের শোকসভা, যেখানে একজন বক্তা আবেগঘন কণ্ঠে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনা দেন। অন্যদিকে নারীদের জন্যও ঘরোয়া পরিবেশে পৃথকভাবে কিরাতের আয়োজন হয়, যা পরিচালনা করেন একজন নারী। এই শোকসভাগুলোতে হুসাইন (রা.), তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের শাহাদাতের করুণ কাহিনি আবৃত্তি ও আবেগময় কাব্যগাথার মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়। বক্তারা শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো ভাষায় সেই ঘটনার বর্ণনা দেন, যা অনেকের চোখে অশ্রু এনে দেয় এবং চারপাশে শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়ে।
এই শোকানুষ্ঠানগুলো সাধারণত বুকে ও মুখে আঘাত, কান্নার আওয়াজ এবং শোক প্রকাশের মাধ্যমে শেষ হয়। অনুষ্ঠান চলাকালে নবী পরিবারের গুণাবলি স্মরণ করে আবৃত্তি করা হয় শোকগীতি ও কবিতা। এসব গানের মাধ্যমে উপস্থিত জনতাকে হুসাইন (রা.)-কে সাহায্য করতে না পারার জন্য অনুশোচনার অনুভূতি এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার আহবান জানানো হয়। তা ছাড়া অনেক জায়গায়, বিশেষ করে ইরাক, ইরান ও লেবাননের কিছু অঞ্চলে ‘তাশাবিহ’ নামক বিশেষ নাট্যানুষ্ঠান তথা কারবালার ঘটনার জীবন্ত মঞ্চায়ন—এর অনন্য সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই নাটকে অংশগ্রহণকারী অভিনেতারা ঐতিহাসিক পোশাক ও সাজসজ্জায় নিজেদের প্রস্তুত করেন। তাঁরা ঘোড়ায় চড়ে ও বিভিন্ন প্রতীক ধারণ করে যুদ্ধের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। পোশাকের রং ও নকশার মাধ্যমে আলাউইত (হুসাইনপন্থী) ও উমাইয়া শিবিরের মধ্যে ভিন্নতা স্পষ্ট করে তোলা হয়, যেন দর্শকরা উভয় পক্ষকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারেন। এই আয়োজন সফল করার জন্য বিত্তবানরা ব্যাপক দান-অনুদান করেন। অনেকেই বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানের খরচ বহন করেন, যাতে এটি আরো বিস্তৃত পরিসরে ও বর্ণিলভাবে আয়োজন করা যায়। উদ্যোক্তারা তাশাবিহ অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল ময়দান প্রস্তুত করেন। হাজার হাজার দর্শক সেখানে জড়ো হয় এবং লাউড স্পিকারের মাধ্যমে নাটকের প্রতিটি মুহূর্ত—যুদ্ধের গতিপথ, বীর যোদ্ধাদের নাম, তাঁদের ইতিহাস ও শহীদদের শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এই দিনে পুরুষরা সাধারণত দাড়ি কামানো থেকে বিরত থাকেন, যেন তাঁদের শোকের অনুভূতি স্পষ্ট হয়। নারীরা শোক ও শোকের প্রতীক হিসেবে ঘরে রান্নার পাত্র উল্টে ফেলে দেন, যা তাঁদের মর্মবেদনা ও স্মৃতির এক চিহ্ন। শিয়া সম্প্রদায় রান্না করার ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকেন; সাধারণত তাঁরা বাড়িতে রান্না এড়িয়ে চলেন। এর বিপরীতে বিশেষায়িত রাঁধুনিরা বড় ধরনের ভোজসভার আয়োজন করেন, যা শহর-গ্রামের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এভাবে তাঁরা হতদরিদ্র ও পথচারীদের খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করে সমাজসেবা ও একতা প্রকাশ করেন।
মহররম মাসের সপ্তম দিন থেকে শোক মিছিল শুরু হয়। সপ্তম দিন উৎসর্গ করা হয় আব্বাস (রা.)-এর প্রতি, অষ্টম দিন উৎসর্গ করা হয় কাসিম (রা.)-এর প্রতি, নবম দিন স্মরণ করা হয় শিশু আবদুল্লাহর, যিনি আবদুল্লাহ ইবনে হুসেন ইবনে আলী (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচিহ্ন। এই শোকাবহ অনুষ্ঠানগুলো দশম দিনে পৌঁছায়, যা স্থানীয়ভাবে ‘থালা’ নামে পরিচিত। বিশেষত ইরানের শিয়া সম্প্রদায় ঐতিহ্যগতভাবে আশুরার শোক সমাবেশে নবী পরিবারের সম্মানার্থে ছবি ও চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে। বিশেষ করে হুসাইন (রা.) ও ইমাম আব্বাস (রা.)-এর প্রতিকৃতি হিসেবে এই চিত্রগুলো ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের ছবির নাম ‘শামায়িল নাকারি’। এই ঐতিহ্যের সূচনা মূলত সাফাভি যুগ থেকে, যা তখনকার সমাজ ও রাজনীতির অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং আজও ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পালনীয়।
২০০৮ সালে ইরানের বিপ্লবী শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিষদ আশুরার সময় নবীর পরিবারের ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের মতে, এ ধরনের ছবি প্রদর্শন এবং অনৈতিক কিছু আচরণ কারবালার হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মহত্ত্ব হ্রাস করে এবং শত্রুদের ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করে। পরিষদটি একই সঙ্গে আশুরার দিন বিকেলে তাঁবু পোড়ানো, ঢোল-করতাল বাজানো ছাড়া অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারা আরো পুনরায় জোর দিয়ে জানায়, শরীর-ত্যাগ বা ‘তাতবির’ নামক রীতিটি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এই সিদ্ধান্ত মূলত আশুরার অনুষ্ঠানকে সৌন্দর্যমণ্ডিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ইসলামী নৈতিকতার সংগতিপূর্ণ রাখার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে।