নাম নাটকের অলংকার, সৌন্দর্য। আগে নাটকের নামগুলোতে পাওয়া যেত কাব্যিক ছোঁয়া। এখন সেই অবস্থা নেই! ভিউ বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য নাটকের উদ্ভট সব নাম রাখা হচ্ছে। বাংলা নাটকে একনাগাড়ে রাখা হচ্ছে ইংরেজি নাম। এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- পান্থ আফজাল
নাটকের মান নেমে গেছে অনেক আগেই। আর বোকাবাক্স হয়ে গেছে জোকারবাক্স! টিভি চ্যানেলের দীনতা ও মানহীন নাটক প্রচারের কারণে হয়ে পড়েছে দর্শকবিহীন। প্রথমদিকে ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম আশার আলো দেখালেও ওপেন প্ল্যাটফর্ম হওয়ার কারণে যাচ্ছেতাই ও মানহীন নাটক প্রচার হচ্ছে। ভিউ ধরার ফাঁদে দর্শককে আকৃষ্ট করতে অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম উদ্ভট গল্পের, নামের নাটক নির্মাণ করছে। নজর কাড়তে বাংলা নামের পরিবর্তে দিচ্ছে ইংরেজি নাম। এ ছাড়াও কনটেন্ট সবার কাছে দৃষ্টিগ্রাহী করার জন্য থাম্বেলে অশ্লীল নাম জুড়ে দিচ্ছে হরহামেশাই। অন্যদিকে টিভি নাটক চ্যানেলের হাত থেকে চলে গেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হাতে। তারা নাটকের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে! ইউটিউবের পর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে সবার আশাব্যঞ্জক সাড়া ছিল। তবে তার দিক থেকেও বিভিন্ন কারণে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভালো কনটেন্ট না দিতে পারা একটা অন্যতম কারণ। যদিও কিছু পরিচিত ইউটিউব ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তাদের ইমেজ ধরে রাখতে সাহিত্যনির্ভর কাজ করে যাচ্ছে। এটি স্বস্তিদায়ক বটে।
এ দেশের টিভি নাটকের রয়েছে সুন্দর সোনালি অতীত। তখনকার নাটক মানেই তুমুল জনপ্রিয়তা। নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। কী সুন্দর সব নামের, গল্পের, সংলাপের ও অভিনয়ের নাটক! সোনালি সময় থেকে নব্বই-পরবর্তী সময়ও অসংখ্য সুন্দর নামের নাটক নির্মিত হয়েছে। ‘সংশপ্তক’, ‘মাটির কোলে’, ‘জোনাকী জ্বলে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘পারলে না রুমকী’, ‘আজ রবিবার’, ‘রূপনগর’, ‘নিমফুল’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘তথাপি’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘বিপ্রতীপ’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘নাইওরী’, ‘তুমি’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘ইতিকথা’, ‘বন্ধন’সহ সুন্দর নামের অসংখ্য নাটক। প্যাকেজ নাটক প্রচার শুরু হওয়ার পর এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসার পরও কিছু কিছু ধারাবাহিক নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সাহিত্যনির্ভর গল্প নিয়ে তৈরি হতো টেলিভিশন নাটক। নামগুলোতেও পাওয়া যেত কাব্যিক ছোঁয়া। নাটক দেখে মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের জীবনাচরণ ঠিক করে নিত সে সময়। কিন্তু এখন নাটকের ভিউ বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য নাটকের যাচ্ছেতাই নাম রাখা হচ্ছে। গড়পড়তাভাবে ইংরেজি নামে কনটেন্ট অবমুক্ত হচ্ছে প্ল্যাটফর্মে। নাটকের মান তো অনেক আগেই গেছে। দর্শক দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিম্নমানের গল্প, উদ্ভট ও অশ্লীল সংলাপ, নতুনদের বিরক্তিকর অপেশাদারি অভিনয়, নির্মাতাদের আনাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি যোগ হয়েছে নাটকের উদ্ভট সব নাম! আবার ভিউ ধরতে ব্যবহৃত হচ্ছে অসামঞ্জস্য ইংরেজি নাম, থাম্বনেল দৃষ্টিকার্ষক করা হচ্ছে ভিউ ধরতে। কনটেন্ট একরকম কিন্তু থাম্বনেলের নাম ভিন্ন। যেন এক মোড়কে আরেক জিনিস! ফলে দর্শক প্রতারিত হচ্ছে। দর্শক আকৃষ্ট করতে যে পোস্টার তৈরিতে বেশি ক্রিয়েটিভিটি দেখানো হচ্ছে, সেই অর্থে নাটকের মানের দিকে কোনো খেয়াল নেই প্রযোজক, নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের। গত কয়েক বছরে দেশের টেলিভিশন চ্যানেল ও ইউটিউবে প্রচার হওয়া অসংখ্য নাটক রয়েছে, যেগুলোর নাম উদ্ভট ও অশ্লীল। নাটকগুলোর এমন নাম শুনে বিভিন্ন সময় বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেন নাট্যজনেরা। অনেকে নাটকের এমন উদ্ভট ও অরুচিকর নামকরণকে পরিচালকদের সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করছেন। নাটকের উদ্ভট নামের অভিজ্ঞতা দেশের নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমেরও হয়েছে। ‘বিরসকাব্য’ নামের একটি নাটকের শুটিং করলেও প্রচারের সময় দেখেন এটির নাম- ‘বউয়ের জ্বালা’! তিনি বলেন, ‘এ ঘটনাগুলো আমরা ঠেকাতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করেছি; কিন্তু এগুলো ঠেকানো যায়নি। আমরা ভিউয়ের জগতে ঢুকে গেছি, যেটাকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অস্বীকার করার প্রয়োজনও নেই। তবে সেখানে আমার একটা দায়ও আছে। দায় হচ্ছে- আমার একটা নাটক দর্শক দেখবে; কিন্তু আমার সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে না, উলঙ্গ হয়ে না। কারণ, আমি তো আসলে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাই।’ এদিকে বাংলা নাটকের নাম উদ্ভট দেখে অনেকেই ভিরমি খাচ্ছেন। বলছেন, রুচি ও মানের বিচারে নামও গুরুত্বপূর্ণ। নামেও আসলে অনেক কিছু যায়-আসে। আবার বাংলা নাটকে ইংরেজি নাম দেখা যায়, যেমন- ‘নাইস টু মিট ইউ’, ‘উরা ধুরা ওয়াও কাপল’, ব্রেক-আপ, মেমরি লস, ব্রেক-ডাউন আফটার ম্যারেজ’, ‘কট ম্যারেজ’, ‘হিট উইকেট’, ‘ব্যাকআপ আর্টিস্ট’, ‘আইইএলটিএইচ’, ‘ফোকাল পয়েন্ট’, ‘হেলমেট’, ‘হাউস হাসব্যান্ড’, ‘ফেয়ার গেম’, ‘হোয়াট ইজ ইয়োর ফাদারস নেম’, ‘হোপলেস ম্যান’, ‘লার্নড ম্যান’, সিক্রেট অব শিউলি’, ‘শর্ট টেম্পার’, ‘হান্ড্রেড আউড অব হান্ড্রেড’, ‘টেনশন টিউশন’ প্রভৃতি। বাংলা নাটকে অযথা এসব ইংরেজি নামকরণ নিয়ে আগেও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই কালচার কিন্তু এখনো বর্তমান। বিশেষ করে ‘উদ্ভট’ ইংরেজি নামগুলো নাটক-টেলিছবি সংশ্লিষ্টদের হাসির পাত্র ছাড়া আর কিছুই করছে না। ‘শালীকে বিয়ে’, ‘জামাই বেশি বুঝে’, ‘মাথা গরম ফ্যামিলি’, ‘মিস্টার ঝামেলা’, ‘প্রবাসীর বউ পোয়াতি’, ‘বুড়া জামাই’, ‘ধনীর ছেলে কৃষক’, ‘বিদ্রোহী বউ’, ‘পিচ্চি বউ’, ‘নকল বৌ’, ‘প্যারায় আছে নবাব’, ‘প্রবাসী পোলার বিয়ে’, ‘বেয়াদব ছেলে’সহ অসংখ্য উদ্ভট নাম রয়েছে। গত কয়েক বছর আগেও উদ্ভট নামে সয়লাব ছিল। যদিও পরিচালক বা প্রযোজকের মতে, এমন আকর্ষণীয় নাম না হলে মানুষ নাটক দেখতে আগ্রহী হয় না; দর্শকরা এমন উদ্ভট নামই পছন্দ করে। তবে এমন নিম্নমানের নিম্ন রুচিসম্পন্ন নাটকের নাম নিয়ে নাটক-সংশ্লিষ্ট অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। দিনদিন নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে মধ্যবিত্ত দর্শক। নাটকের নাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা অনেক পরিচালক ও টিভি কর্মকর্তা বুঝতে চান না। আগেও ঝালখোর, সিকন্দার বক্স, আরমান ভাই, কিড সোলায়মান ইত্যাদি নামনির্ভর নাটক নির্মিত হতো। তা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে এ সময়ও ভালো নামের ও গল্পের নাটক এবং কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে যেটা আশার সঞ্চার করে। যেমন প্রিয় প্রজাপতি, তুমি, যৌথ ফ্যামিলি, চুপকথা, বাবার ছায়া, মন বদল, মায়াডোর, চলো হারিয়ে যাই, মাটির মেয়ে, সত্য বলা মহাপাপ, চিঠি দিও, মিথ্যে প্রেমের গল্প, পায়েল, সন্ধি, কেন এই সঙ্গতা, সিন্দুক, মায়াবতী প্রভৃতি। যদিও তা খুবই অপ্রতুল। ইদানীং নির্মিত নাটকগুলোর নামের সিংহভাগই ইংরেজি। যদিও বাংলা নামের পাশাপাশি ইংরেজি নাম ব্যবহারের রীতি আগেও ছিল। তবে ইদানীং ইংরেজি নামের প্রতি টান যেন বেশিই। বাংলা নাটকে অযথা ইংরেজি নামকরণ সবার কাছে হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর ধরে এ ট্রেন্ডটা দেখা যাচ্ছে। এখন বাংলা নামের নাটক খুব কম চোখে পড়ে। নাটকগুলোর এমন নাম শুনে রীতিমতো বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নাটক-সংশ্লিষ্টরা। এমন নামকরণ সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবই দায়ী।