রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন ক্ষমতার বিষয়ে নতুন কাঠামো তৈরি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ কাঠামোতে ক্ষমা প্রদর্শন আইনের মাধ্যমে একটি ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে। ছয় সদস্যের বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকবেন অ্যাটর্নি জেনারেল। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন জাতীয় সংসদ কর্তৃক মনোনীত সরকারদলীয় একজন এমপি, বিরোধীদলীয় এমপি, কারা মহাপরিদর্শক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত একজন সিভিল সার্জন ও একজন মনোবিদ। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করার রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা থাকবে না। বিশেষজ্ঞ কমিটি বা বোর্ডের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
আইনি বিচারে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার ক্ষমতা নিয়ে তৈরি এ নতুন কাঠামোতে একমত পোষণ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলেছে, অতীতে বিষয়টি নিয়ে ওই ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। চিহ্নিত ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করা হয়েছে। বর্তমানে দণ্ড মার্জনা, দণ্ড মওকুফ, দণ্ড হ্রাস, দণ্ড স্থগিত এবং দণ্ড বিলম্বের বিষয়গুলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ এবং ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১, ৪০২ ও ৪০২ক ধারা অনুসারে পরিচালিত হয়।
কমিশন জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার যে রাজনৈতিক উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে তা সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচার কাজ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে। একই অপরাধীকে দুবার ক্ষমা প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষমা প্রদর্শনের এ ঘটনাগুলো আমাদের দেশে আইনের শাসনের ধারণাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
নতুন কাঠামোতে বোর্ডের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, গঠিত ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ডের সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করবে। ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ড বছরে ন্যূনতম দুবার, জানুয়ারি ও জুলাই মাসে সভা করবে। সরকার বোর্ডের সভা অনুসারে সদস্যদের জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা করবে। আগ্রহী দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি নির্ধারিত ফরমে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর ক্ষমা প্রদর্শনের আবেদন করবেন। আবেদন যাচাইবাছাই করে অ্যাটর্নি জেনারেল ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ডের সভা আহ্বান করবেন। ক্ষমা প্রাপ্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে বোর্ড একমত না হতে পারলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এরপর সেই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী দপ্তরকে জানানো হবে। বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী বিভাগ ক্ষমা প্রদর্শন করবে।
নতুন কাঠামোয় বোর্ডের সুপারিশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি অনুসরণীয় নীতি ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- অনুকম্পা প্রদর্শন একটি বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা, তাই অত্যন্ত বিরল এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রেই এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। অপরাধের মাত্রা ও ধরন গুরুত্ব পাবে। ভুক্তভোগী এবং সার্বিকভাবে সমাজের ওপর সংশ্লিষ্ট অপরাধের প্রভাব বিবেচনা করতে হবে। দণ্ড প্রদানের পরে অপরাধীর আচরণ আমলে নিতে হবে। অপরাধী আদালতে দোষ স্বীকার করেছে কি না দেখতে হবে। অপরাধী তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত কি না জানতে হবে (আচার-আচরণ থেকে)। যেখানে শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেখানে অপরাধী কারাদণ্ডের কতটুকু খেটেছে এবং কতটুকু বাকি আছে সেটা দেখতে হবে। অপরাধীর বয়স এবং সার্বিক বিবেচনায় তার সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বিবেচনা করতে হবে। অপরাধী শারীরিক বা মানসিক রোগাক্রান্ত হলে তার ধরন দেখতে হবে। জনমত বিবেচনা করতে হবে। ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে বা না করা হলে তার কারণ জানাতে হবে। এর আগে আবেদনকারী নির্ধারিত ফরমে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করবে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধান বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত সময়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছে। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত পোষণ করেছে বলে জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আগামীতে রাষ্ট্রপতির একক কর্তৃত্ব থাকবে না। আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের মতো আলোচিত বিষয়টি। তিনি আরও বলেন, আমরা বিগত সময় দেখেছি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বড় বড় অপরাধ করা আসামিদের ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিশেষে একটা সীমাবদ্ধতা তৈরিতে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইনসাফ ও সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটি করা হচ্ছে। ক্ষমার ফাঁকে যেন কোনো দুর্বৃত্ত বা দাগি, কোনো খুনি বা আসামি ছাড়া পেয়ে না যায়। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারবেন, তবে সেটা ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতির ভিত্তিতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বা কমিটি ক্ষমা করতে পারবেন, তা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য একটা বডি (কমিটি) করা হয়েছে। যে বডির সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারবেন। ন্যায়বিচার ও ইনসাফভিত্তিক বিচার নিশ্চিত করার জন্য এটি একটি নতুন ডাইমেনশন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স জানান, রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের মতো গুরুতর বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আইন থাকা জরুরি। এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত।