বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে খরচের চাপ বাড়বে

ভুগবে নিম্ন ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ চতুর্মুখী সংকটের শঙ্কা সিপিডির

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। জ্বালানির এই বাড়তি মূল্য উসকে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এরই মধ্যে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়ছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে অস্বস্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ডিজেলের মূল্য বাড়ায় কৃষির উৎপাদন খরচ বাড়বে। অনেক কৃষক আবাদ ছেড়ে দেবে। এতে উৎপাদন কমবে, আমদানি বাড়বে। মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটা এমন সময়ে এলো যখন দেশের অর্থনীতি নানা কারণে চাপে আছে। এতে চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি হবে। সবচেয়ে বেশি ভুগবে নিম্ন আয়ের ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ।

গতকাল রাজধানীতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত  কি?’ শীর্ষক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন, সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, তেল বিক্রি করে চলতি বছরে ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ ছাড়া ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি উল্টো লোকসানের কথা বলছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমছে অথচ আমাদের দেশে বাড়ানো হলো। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাড়তি নেই। ভিয়েতনাম উদীয়মান অর্থনীতির একটা দেশ অথচ সেখানে ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ৯৭ দশমিক ৯ টাকা।  তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, এটা নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে। আমরা বলছি হংকং-এ নাকি জ্বালানি তেলের দাম আরও বেশি। কার সঙ্গে কী তুলনা করছি? হংকং-এ মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার ৬৬০ ডলার। আমাদের ২ হাজার ৫০৩ মার্কিন ডলার। কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে মাথাপিছু আয়ও দেখতে হবে।

জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ডিজেলে দাম বৃদ্ধিতে কৃষির উৎপাদন খরচ বাড়বে। অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দেবে, ফলে আমদানি বেড়ে যাবে। শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়বে। ব্যবসার লভ্যাংশ কমে যাবে। রপ্তানি কমবে। পণ্যের দাম বাড়বে। বড় বিপদে পড়বে নিম্ন ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ। সঞ্চয় ভেঙে খাবে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সুদের হার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখান থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বিপিসি এককভাবে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকে কভিড থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তার ওপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবাই চাপে পড়েছে।

ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে দাবি করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত ছয় বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সেখান থেকে সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? তিনি বলেন, সাবসিডি ম্যানেজমেন্টের নামে মূল্যবৃদ্ধি না করে অব্যবহৃত অর্থ দিয়ে সাবসিডি অ্যাডজাস্ট করা যায়। আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় ওই কৌশল নেওয়া যেত। ভোক্তার ওপর দায় চাপানো ঠিক হয়নি।

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ সময়ে আছি। এই সময়ে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হয়নি। জ্বালানি তেলে কর কমিয়েও দাম স্বাভাবিক রাখা যেত। সাবসিডি কেউই পছন্দ করে না। ধীরে ধীরে সেটা কমানো যেত। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে ১ হাজার টাকা খরচ বাড়বে কৃষকের। কৃষি খাতে ১৫ লাখ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, যার ৭৫ শতাংশ ডিজেলচালিত। এখানে অন্তত আগের দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে হবে। ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশ বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, গ্যাস সরবরাহ না থাকায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে কারখানায়। নতুন দামে কিনে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। দুই মাস আগেই দাম কমিয়েছে ক্রেতারা। এদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সামনে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো লাগতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দিনে শহরে যাতায়াত খরচ বেড়েছে গড়ে ৭০ থেকে ২০০ টাকা। আর দূরপাল্লার বাসে খরচ বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। শহরে প্রতি কিলোমিটারে আড়াই টাকা নির্ধারণ করা হলেও ৩ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে বিভিন্ন পরিবহন।

সর্বশেষ খবর