সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

হঠাৎ মৃত্যুপুরী মাদারীপুর

ফিটনেসবিহীন বাসের বেপরোয়া গতি, নিহত ১৯

প্রতিদিন ডেস্ক

হঠাৎ মৃত্যুপুরী মাদারীপুর

হঠাৎ মৃত্যুপুরী হলো মাদারীপুর। পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের মাদারীপুর জেলার শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ১৯ যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। দুর্ঘটনাটি ঘটে গতকাল সকালে। ১৪ জনের মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। তিনজন শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং দুজন মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ পরিবহনের মালিক সাব্বির হোসেন গোপালগঞ্জ সদরের কাঠি গ্রামের বাসিন্দা। এ ছাড়া বগুড়া, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর ও কুড়িগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন। মাদারীপুর প্রতিনিধি বেলাল রিজভী স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানান, গতকাল সকালে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের একটি বাস পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যায়। এ সময় দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১৪ জন।  হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি হাবিব বিনতে সালমা জানান, নিহতের সংখ্যা আপাতত ১৯ জন। হতাহত বহু। উদ্ধারকাজ চলছে। তিনি আরও জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গাড়িটি অতিরিক্ত গতিতে চালাচ্ছিলেন চালক। আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি গাড়ির সামনের চাকা ফেটে গিয়েছিল। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত বলা যাবে। নিহত  ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম।

দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটির যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শী সাইফুল ইসলাম জানান, গাড়িটি ছেড়ে আসার সময় গাড়ির চালকের সহকারী বলছিল- ওস্তাদ! গাড়ির ব্রেক লুজ, কাজ করে না। তখন চালক বলেন, এই ট্রিপ মেরে গাড়ি গ্যারেজে দেব। এরপর গাড়ি ছেড়ে আসে। মাঝপথে ব্রেকে কয়েকবার সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এরপরই মাদারীপুরের শিবচর এসে  দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি আরও জানান, গাড়িটি শুরু থেকে অতিরিক্ত গতিতে চলছিল। নিহতরা হলেন- ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার হিতোডাঙ্গা গ্রামের সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল (৩৮), গোপালগঞ্জের   গোপীনাথপুর গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া বাহার (৪২), নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার কালনা গ্রামের বকু সিকদারের ছেলে ফরহাদ সিকদার (৩০), গোপালগঞ্জ সদরের শান্তি রঞ্জন মন্ডলের ছেলে অনাদী মন্ডল (৪২), গোপালগঞ্জের বনগাঁও এলাকার সামছুুল শেখের ছেলে মোস্তাক আহমেদ (৩০), গোপালগঞ্জ সদরের ছুটকা গ্রামের নশর আলী শেখের ছেলে সবুজ শেখ, গোপালগঞ্জ সদরের পাচুরিয়া গ্রামের মো. মাসুদের মেয়ে সুইটি আক্তার (২২), গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কাঞ্চন শেখের ছেলে মো. কবির শেখ, গোপালগঞ্জ সদরের আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি (২০), গোপালগঞ্জ মুকসুদপুর উপজেলার আমজাদ আলী খানের ছেলে মাসুদ খান (৩২), খুলনার সোনাডাঙ্গার শেখ আহমেদ আলী খানের ছেলে শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন (৪২), খুলনার চিত্তরঞ্জন মন্ডলের ছেলে চিন্ময় প্রসন্ন মন্ডল, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার পরিমল সাধুর ছেলে মহাদেব কুমার সাধু, খুলনার টুটপাড়ার শাজাহান মোল্লার ছেলে আশরাফুল আলম লিংকন, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখীপুর গ্রামের আমজাদ আলী সরদারের ছেলে রাশেদ সরদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের আলী আকবরের ছেলে জাহিদ। অন্যদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনায় শিবচরে ১৭ জন এবং ঢাকা মেডিকেলে আরও দুজনসহ ১৯ জন নিহত হয়েছেন।

নিহতদের পরিবারকে সহায়তা : নিহতদের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়।’

অতিরিক্ত গতির কারণেই দুর্ঘটনা : অতিরিক্ত গতির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর রিজিয়নের  এসপি মাহবুব হোসেন। তিনি জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি অতিরিক্ত গতির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

তদন্ত কমিটি : মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ জানতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব কুমার হাজরার নেতৃত্বে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সৌদি যাওয়া হলো না ঝুমার : রোজার শুরুতে সৌদি প্রবাসী স্বামীর কাছে যাবেন বলে দেবরকে সঙ্গে নিয়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসছিলেন ঝুমা বেগম। দুর্ঘটনায় থমকে গেছে তার জীবন, তার স্বপ্ন। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর সৌদি প্রবাসী আমিনুল ইসলামের স্ত্রী ঝুমা বেগম চার সন্তানের জননী। ঢাকায় আসার জন্য ইমাদ পরিবহনের যে বাসে তিনি চড়েছিলেন, গতকাল সকালে মাদারীপুরের শিবচরে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে সেটি খাদে পড়ে যায়। ঝুমার পা ভেঙে গেছে। মাথা ও কোমরে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। ৩৪ বছর বয়সী এই নারী কোনো দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না তা চিকিৎসকরা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। ঝুমার মামাতো ভাই মেজবাহ সাংবাদিকদের বলেন, আগামী সপ্তাহে আপুর (ঝুমা) সৌদি আরবে দুলাভাইয়ের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কয়েক দিন আগে সৌদি আরব থেকে ভিসা পাঠিয়েছেন। আজ সেই ভিসার কাগজপত্র নিতে দেবরের সঙ্গে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় আপুর ছোট দেবর সজীব মারা গেছেন। তারা পাশাপাশি সিটে ছিলেন।

চোখের চিকিৎসা করানো হলো না আলী আকবরের : দুর্ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- ইমাদ পরিবহনের সুপারভাইজার মিনহাজ বিশ্বাস (২২) ও শেখ আলী আকবর (৭৫)। আলী আকবরের ভাতিজা সার্জেন্ট জাহিদুল ইসলাম হাসপাতালে বলেন, তাদের বাড়ি বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার কুমলাই গ্রামে। এলাকায় একটি মাদরাসায় এক সময় শিক্ষকতা করতেন তার চাচা। অবসরে গিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। জাহিদুল বলেন, গ্রামের বাড়ি থেকে মেয়েজামাই জাহাঙ্গীর হোসেনকে (৩৬) সঙ্গে নিয়ে চোখের ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় আসছিলেন উনি। রাস্তায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। দুর্ঘটনার সময় আকবরের সঙ্গে থাকা জাহাঙ্গীরও আহত হয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানান সার্জেন্ট জাহিদুল।

ইমাদ পরিবহনের চালক ও সহকারী নিহত : ইমাদ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হোসেন। তিনি গোপালগঞ্জ সদরের কাঠি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জানান, ওই বাসের চালক জাহিদ হোসেন ও সুপারভাইজার মিনহাজ বিশ্বাস দুজনই মারা গেছেন। তার দাবি, দুর্ঘটনার আগে গাড়িটি ৭৯ কিলোমিটার বেগে চলছিল; সামনের চাকা ফেটে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও যাত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, বাসটি চালানো হচ্ছিল অনেক বেশি গতিতে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাব্বির বলেন, ইমাদ পরিবহনের গাড়ি কোথায় কত গতিতে চলছিল তা তারা জিপিএস পদ্ধতির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

 

বগুড়া : শাজাহানপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় পৃথক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন। শাজাহানপুরে ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী সাব্বির হোসেন (৩৫) ও শিবগঞ্জে ট্রাকচাপায় অটোভ্যান চালক আবদুল বারী (৬০) নিহত হন।

ময়মনসিংহ : জেলার ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়নের বইন্যার ব্রিজ এলাকায় গত রাত পৌনে ৮টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা জানাতে পারেনি ত্রিশাল থানা পুলিশ।

চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় গাছের সঙ্গে প্রাইভেট কারের ধাক্কা লেগে চালক মুন্না শেখ (৩০) নিহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে দর্শনা পৌর এলাকার হঠাৎপাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত মুন্না শেখ সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহের লাল্টু শেখের ছেলে। তিনি দর্শনা মোবারকপাড়ায় শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করতেন।

পিরোজপুর : পিরোজপুর-নাজিরপুর-ঢাকা সড়কের কদমতলা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা এক নারী মারা গেছেন। নিহত নাজমিন বেগম (৩০) পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বুনিচাকাঠী গ্রামের আলমগীর মোল্লার স্ত্রী এবং পিরোজপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ব্রাহ্মণকাঠি এলাকার ইলিয়াস দরানীর মেয়ে। এ দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলে থাকা নিহত নারীর তিন বছরের সন্তান ও স্বামী গুরুতর আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল ১০টার দিকে পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়নের পিরোজপুর-নাজিরপুর-ঢাকা সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে বালুবোঝাই ট্রাক্টর চাপায় এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। গতকাল দুপুরে উপজেলা সদরের ব্র্যাক মোড় থেকে শেখ হাসিনা ধরলা সেতু সড়কের পানিমাছকুটি কাশিয়াবাড়ী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুর নাম মেরাজ হোসেন (৪)। সে ওই এলাকার হাফিজুর রহমানের ছেলে।

সর্বশেষ খবর