অবশেষে বাতিল হচ্ছে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮। পাশাপাশি এর স্থলে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০২৩ প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন এ আইনের খসড়া গতকাল মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়। আইনটি এখন ‘ভেটিং’ তথা যাচাই ও মতামতের জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এর আগে তীব্র সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে আইসিটি আইন বাতিল করে সরকার। ওই সময় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ পাস করা হয়। তবে এ আইন নিয়েও অনেক সমালোচনা রয়েছে। এ আইনটিও বাতিল করার দাবি ছিল বিভিন্ন মহল থেকে। অবশ্য এ মুহূর্তে আইনটি বাতিল হচ্ছে এমন কোনো পরিষ্কার তথ্য জানানো হয়নি। বরং জানানো হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০১৮-এর স্থলে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০২৩ প্রতিস্থাপন করা হবে। একইভাবে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০১৮-এর কয়েকটি ধারায় সংশোধন আনা হবে। এ ছাড়া নতুন আইন সাইবার সিকিউরিটিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানির মামলায় জেলের বিধান বাতিল করে শুধু জরিমানার বিধান সন্নিবেশ করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার এক সূত্র জানান, গতকালের বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি স্থগিত করে এর ওপর সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারাই পরিবর্তন করে যুক্ত করা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইনে। আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী নতুন এই সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট তথা সাইবার নিরাপত্তা আইন মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করেন। আইনটিকে মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারা ছিল, সেগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও অক্ষত রাখা হয়েছে। সেসব ধারায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তনের তথ্য জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক অপরাধই ছিল জামিন-অযোগ্য। সেসব অপরাধকে সাইবার নিরাপত্তা আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আবার মানহানির অপরাধের যে ধারায় সাজা ছিল কারাদণ্ড, সেটি বদলে সাজা কেবল জরিমানা করা হয়েছে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অনেক অপরাধের ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে প্রথম অপরাধের সাজার চেয়ে দ্বিগুণ বা অনেক বেশি সাজার বিধান ছিল। সাইবার নিরাপত্তা আইনে সে রকম কিছু থাকছে না। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলেও সাজা প্রথম অপরাধের মতো একই থাকবে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি রয়েছে। এতে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, সেজন্য তিনি অনধিক তিন বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত আইনে এ অপরাধের জন্য কারাদণ্ড বাদ দিলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এখন এ অপরাধের জন্য অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। মানহানির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কারাদণ্ড নয়, জরিমানার বিধান থাকবে বলে জানান আইনমন্ত্রী। তবে জরিমানা না দিলে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। কিন্তু অপরাধের মূল শাস্তি হলো জরিমানা। আইনমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত আইনে অনেক ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ছিল। বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তি কমানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১-এর কথা উল্লেখ করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ ধারায় (২১) মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি এ অপরাধ করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, এ সাজা কমিয়ে এখন করা হয়েছে সাত বছর। এ ছাড়া অনেক ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধের জন্য সাজা দ্বিগুণ বা সাজা বাড়ানো ছিল। প্রস্তাবিত আইনে প্রতিটি ধারায় যেখানে দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে বাড়তি সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানির অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে এই ব্যক্তির এ কাজ হবে একটি অপরাধ।
কোনো ব্যক্তি এ অপরাধ সংঘটন করলে তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর এ অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা আরও বেশি হবে। প্রস্তাবিত আইনে এটি (২৮ ধারা) পরিবর্তন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে (আগে অজামিনযোগ্য ছিল) এবং সাজা কমানো হয়েছে। এখন এ অপরাধে সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারাও পরিবর্তন করা হচ্ছে প্রস্তাবিত আইনে। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত আইনে সাজা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের বাড়তি সাজা বাতিল করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। এটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
হ্যাকিংয়ের জন্য অনধিক ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে একটি ধারায়। এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যমের জন্য আলাদা কোনো বিধান রাখা হয়নি। বিদম্যান মামলাগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে বলে জানান মন্ত্রী।
কবে নাগাদ নতুন আইনটি হবে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে। সেই অধিবেশনে বিলটি সংসদে পেশ করা হবে।’ সেই অধিবেশনে আইনটি পাস হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তখন চলমান মামলাগুলো স্বাভাবিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে যাবে। আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার অপরাধসংক্রান্ত কারিগরি বিষয়ের অপরাধের ক্ষেত্রে আইনে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। নতুন আইনে কোনো বিতর্কিত ধারা থাকবে কি না, সেটি পরে সংশোধন হবে কি না- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, নতুন আইনটি নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না এবং এটি সংশোধনের প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন তিনি। এদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে বিকালে সচিবালয়ে নিয়মিত ব্রিফিং করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিল গত পাঁচ বছর। এ আইন নিয়ে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন সারা বিশ্বে আইসিটি-সংক্রান্ত অপরাধে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তা সামনে রেখেই সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হবে। এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হয়ে যাবে। মাহবুব হোসেন বলেন, নতুন আইনের আওতায় ‘জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা’ নামে একটি এজেন্সি থাকবে। সাইবার-সংক্রান্ত কিছু অপরাধ চিহ্নিত করে এর শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আইনে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা বেশি ছিল। নতুন আইনে বেশির ভাগই জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আর সাজার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাভোগ বেশি ছিল। কিন্তু নতুন আইনে কারাভোগে সাজার পরিমাণ কমিয়ে আর্থিক জরিমানা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ধারার বিবরণ না দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নতুন আইনে ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ নম্বর ধারা আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য। এ ছাড়া ধারা ১৮, ২০, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬ জামিনযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি অনুপ্রবেশ’ নামের ১৭ নম্বর ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল সাত বছরের জেল, এখন সেটি তিন বছরের জেল নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ব্রিফিংয়ে আরও জানান, বাংলাদেশ অ্যালাইড হেলথ শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২৩-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ বোর্ডের প্রধান থাকবেন চেয়ারম্যান, তিনি হবেন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী। এমবিবিএস, বিডিএস, নার্সিং, ফার্মাসি ছাড়া স্বাস্থ্যশিক্ষার অন্য ধারার শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে এ বোর্ড। এ ছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন (সংশোধন), ২০২৩-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন দেওয়া হয়েছে প্রত্নসম্পদ আইন, ২০২৩-এর খসড়ায়ও। মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস পালন করা হতো ১২ ডিসেম্বর। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। ১২ ডিসেম্বর এখন থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস পালন করা হবে।’
► সাংবাদিক গ্রেফতারের সুযোগ থাকবে না
► আইন যেন স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা না হয়
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        