শেরপুরের রেণু বেগমের ফুসফুসে ক্যান্সার। দুই বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছেন তিনি। প্রতি মাসে প্রায় ৫-৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। কেমোথেরাপির জন্য জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি।
তার মেয়ে রুবি আক্তার বলেন, আমি অন্যের বাসায় কাজ করে মায়ের ওষুধের খরচ চালাই। আগে ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধে মাস চলত। এখন দাম বাড়ায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা বেশি খরচ হয়। অনেক সময় থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে ওষুধের টাকা জোগাড় করতে পারি না। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের ৬১ লাখ মানুষ প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নামছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধের পেছনে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দেখা গেছে, ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার ও কিডনির চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগী। গবেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া ব্যয় কমানো অসম্ভব। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে রোগের প্রকোপ, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও। চিকিৎসা ব্যয় বিষয়ে সবশেষ পরিস্থিতি জানতে ১৪ হাজারের বেশি রোগী ও পরিবারের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সরকারের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গত জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ের ধাক্কা ও দারিদ্র্য : ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য’ উপস্থাপন করে বিআইডিএস। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এই স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। অর্থাৎ তখন দেশে যত দরিদ্র মানুষ ছিলেন, তার মধ্যে ২০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে এই স্বাস্থ্যগত কারণে। এর মূল কারণ চিকিৎসা বাবদ মানুষের পকেটব্যয় বেড়ে যাওয়া। ১৯৯৭ সালে যা ছিল ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২০ সালে ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে তা ৭৩ শতাংশে উঠে যায়। গ্লোবাল হেলথ এক্সপেনডিচার ডেটাবেজ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ব্যক্তিমানুষের চিকিৎসা বাবদ যত ব্যয় হয়, তার ৭৩ শতাংশ ব্যক্তিকে বহন করতে হয় অর্থাৎ সরকার বহন করছে মাত্র ২৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে কেবল আফগানিস্তানে এই ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, যেখানে প্রতি ১০০ টাকা স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে ব্যক্তির পকেটব্যয় ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিআইডিএস স্বাস্থ্য অর্থনীতি গবেষক ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া রোগীদের মাসিক ব্যয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি মাসে গড়ে ১৯ হাজার টাকা ব্যয় হয় ক্যান্সার রোগীর। আর হৃদরোগের পেছনে ব্যয় হয় ৮ হাজারের বেশি। মূলত ওষুধ কিনতেই পকেট খালি হয় রোগীর। মোট চিকিৎসা ব্যয়ের অর্ধেকের বেশিই যায় ওষুধের পেছনে। এর পরই রয়েছে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসকের ফি। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬৮ দশমিক ৫০ ভাগ টাকা। রোগীকে সবচেয়ে বেশি ৬৪ ভাগ টাকা ব্যয় করতে হয় ওষুধ খাতে। এর পর হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ২৩ ভাগ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় হয় ৮ ভাগ অর্থ। নিজ পকেট থেকে ব্যয় বাড়ার কারণে ১৬ দশমিক ৪ ভাগ রোগী প্রয়োজন থাকলেও চিকিৎসা নিতে পারেন না। ২০১২ সালে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় ছিল ৬৪ ভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘ওষুধের খরচ কয়েকটি কারণে বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে, দেশের মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনতে পারে এবং অপ্রয়োজনে ওষুধ খায়। কোয়াকদের কাছে গেলে তারাও ইচ্ছামতো ওষুধ দেয়, অনেক অসাধু চিকিৎসকও অতিরিক্ত ওষুধ দিয়ে থাকেন। এজন্য দায়ী কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী মার্কেটিং। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ওষুধ উৎপাদন হয়। এজন্য তারা ‘পুশ সেল’ করে। তাই চাহিদা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী উৎপাদন করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অডিট চালু করতে হবে। কোম্পানির আগ্রাসী মার্কেটিং বন্ধ হলে খরচ কমবে, এতে ওষুধের দামও কমবে। ওষুধ সেবনের পরিমাণ এবং দাম যৌক্তিক হলে চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে।’