বাণিজ্যের ঘরে তালা দিল ভারত। স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে দেশটি নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দুই দেশের বাণিজ্যে ভবিষ্যতে ‘ডেডলক’ অবস্থা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার ভারতের রপ্তানি। বাকি ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বাংলাদেশের বাণিজ্য। এই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশির ভাগ রপ্তানি আয় আসে পোশাক খাত ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য থেকে। মূলত ভারতের ল্যান্ডলক সাতটি রাজ্য সেভেন সিস্টার্সে স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানির ওপর বাংলাদেশের বাণিজ্য নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বাণিজ্যে তালা পড়েছে সেই সেভেন সিস্টার্স আর স্থলবন্দরে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এটি প্রতি বছরই বাড়ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে শতকোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হুমকিতে পড়েছে। আরও প্রায় ১০ কোটি ডলারের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে, যার মধ্যে একটি শিল্প গ্রুপের রপ্তানির পরিমাণ ৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ প্রতিদিনের বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, নিষেধাজ্ঞার পর যশোরে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দরে (বেনাপোল-পেট্রোপোল) রপ্তানির অপেক্ষায় শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। স্থলবন্দর বন্ধ হলেও সমুদ্রপথে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু কলকাতা ও নাভাসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যাবে। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করা যেত। স্থলপথে নিষেধাজ্ঞার ফলে এসব পণ্য রপ্তানিতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। ফলে খরচ ও সময় কয়েক গুণ বাড়বে। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞা কেন হলো তা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত। স্থলবন্দর দিয়ে আমাদের যেমন সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত হয়নি, তেমনি ভারতের নিষেধাজ্ঞাও দুই দেশের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য। বিগত কয়েক বছরে দেশটিতে মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল গার্মেন্ট পণ্য। বাকি ৪০ শতাংশের মধ্যে কৃষি ও খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক, পিভিসি পাইপ, ফার্নিচার, মাছ, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, ব্যাটারি ইত্যাদি। বিশেষ করে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে বাংলাদেশের প্রাণ-আরএফএলের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রহিম-আফরোজের ব্যাটারির ভালো বাজার রয়েছে ভারতে। স্থলবন্দরগুলো দিয়ে প্রায় ১৫ কোটি ডলারের কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয় বলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের এই শিল্পগুলো।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিরেক্টর (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সেভেন সিস্টার্সে বছরে প্রায় ৫ কোটি ডলার পণ্য রপ্তানি করে থাকি আমরা। ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে পুরো রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছি আমরা।’ প্রাণের এই বিপণন কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ থেকে যে সাতটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে পাঁচটি বন্দর দিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাকি দুটি দিয়ে রপ্তানির সুযোগ থাকলে কিছু পণ্য পাঠানো যাবে, নয়তো ভারতে প্রাণের রপ্তানি বাণিজ্যে পুরো ডেডলক অবস্থা সৃষ্টি হবে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য এখনই কোনো ডেডলক বা স্থবিরতার পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করছি না। তবে সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়াগুলো নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক এবং দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সরবরাহ শৃঙ্খলার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।’
সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব আজকে শুধু দুই দেশের অর্থনীতিই নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সংযুক্তির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে যেন সমন্বয়হীন অশুল্ক বাধা বা পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিনষ্ট না করা হয়, সেদিকে সব পক্ষের সচেতন দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংকটের শুরু জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে। দুই দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ ধীরে ধীরে বাণিজ্যের দিকে মোড় নিচ্ছে। ভারতের দিক থেকে প্রথমে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ঘোষণার পর বাংলাদেশ স্থলপথ দিয়ে দেশটি থেকে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এবার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক পিভিসি বা কাঠের ফার্নিচারসহ অন্তত সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। গত শনিবার দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) এই নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করে। এ বিষয়ে সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানতে পারিনি। তবে আমরা যেহেতু ভৌগোলিকভাবে কানেক্টেড একটা দেশ, আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা, পরিবহন ব্যয়সহ অন্যান্য বিষয়গুলো নির্দিষ্ট। এ ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন সময় আমাদের কৃষিপণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করি, ভারতও করে। এটা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া এবং আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। সেখানে যদি সমস্যা দেখা দেয় বা তৈরি হয় তাহলে উভয় পক্ষ আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করব।’