ব্যয়সংকোচন, ছোট বাজেট-কোনো কিছুই সরকারের ঋণে লাগাম টানতে পারছে না, বরং দিনে দিনে বাড়ছে দেনার পরিমাণ। ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ার কারণ কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না। এ ছাড়া রয়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা, ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতাসহ বহির্মুখী নানান চাপ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে নিট ঋণের স্থিতি ধরা হয়েছে ২১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থাৎ আগামী বছরের জুন শেষে এটি বেড়ে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণের স্থিতি ২৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৭-২৮ অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২৯ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। দেখা যাচ্ছে, সামনের তিন অর্থবছরে সরকারের ঋণের স্থিতি বর্তমানের চেয়ে আরও ৮ লাখ কোটি টাকা বেড়ে যাবে। বছর বছর এই বাড়তি ঋণের বোঝা আর্থিক খাতে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে খোদ সরকারের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারের ঋণ এখনো টেকসই পর্যায়ে থাকলেও তা বাইরের আঘাত ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট চাপের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অনুদান ও নমনীয় সুদে ঋণের পরিমাণ কমে গেছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ঘটলে তুলনামূলক উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। এর ফলে ঋণ পরিশোধে ব্যয় আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে যদি রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার না করা যায়, তাহলে ঋণের স্থিতি ও ঝুঁকি দুটিই বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সরকার চাইলেও কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ভাটা, ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সর্বশেষ ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী চাপ তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণে এরই মধ্যে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বাড়তে শুরু করেছে। বাড়তি দামে জ্বালানি ও খাদ্য কিনতে গেলে সরকারের ব্যয় বাড়বে। বাড়তি খরচ সামাল দিতে সরকারকে আবারও ঋণ নিতে হবে। ফলে দিনে দিনে সরকারের দেনা বাড়তেই থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বলেন, সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ঋণ বাড়ছে। যদিও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাটছাঁট করে সরকার ব্যয় কমাতে চাইছে, তাতে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। কারণ, রাজস্ব আয়ের যে টার্গেট, আদায় তার চেয়ে অনেক কম। শুধু এনবিআর সংস্কার করে আয় বাড়ানো যাবে না। এজন্য ব্যবসাবাণিজ্যে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা কোনোভাবেই ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য উপযোগী নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা, শিল্পকারখানায় হামলা অর্থনীতিতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এই অনিশ্চয়তা কাটাতে না পারলে রাজস্ব আয় বাড়বে না।