চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর টানা ১৫ ঘণ্টার সংঘর্ষ থামলেও আতঙ্ক কাটেনি। উভয় পক্ষে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক-উত্তেজনা। পুরো এলাকা থমথমে।। এদিকে রবিবার দুপুরে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা আজ মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সব ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে প্রশাসনিক ভবনে নিয়োগ পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে চবি প্রশাসন।
চবির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। খসড়া তৈরি হয়েছে, রাতের মধ্যেই থানায় দায়ের করা হবে। এর মধ্যে একটি মামলা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায়, আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্ট করার ঘটনায়; আর তৃতীয় মামলার ব্যাপারে পরে জানানো হবে।’
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, ‘এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক। ফের কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবাইকে নিয়ে কাজ করছি। ফের সংঘাত এড়াতে ১৪৪ ধারা মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
গতকাল সকালে সরেজমিন দেখা যায়, পাল্টে গেছে চবি ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক চিত্র। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার মধ্যে আতঙ্ক। স্বাভাবিক সময়ে কোলাহলে মুখর থাকা সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, শহীদ মিনার, গোলচত্বর ও ২ নম্বর গেট ছিল অনেকটাই ফাঁকা। তবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাস এবং শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের বাহন শাটল স্বাভাবিক নিয়মে চলাচল করেছে। একই চিত্র ছিল জোবরা গ্রামেও। স্থানীদের অনেকের মধ্যে দেখা গেছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। তাই পুরুষশূন্য হয়ে গেছে পুরো এলাকা।
সংঘর্ষের পর রবিবার রাতে প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত চলা এ বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জেলা প্রশাসক ও গ্রামবাসীর প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা, দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে স্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতারের বক্তব্যের প্রতিবাদে গতকাল বিকালে ছিল অবস্থান কর্মসূচি ও মিছিল। শহীদ মিনারে এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, ‘চবি মেডিকেলের তথ্যমতে ১৫০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, কিন্তু তিনি (উপাচার্য) বলছেন মাত্র ২০০ জন আহত। উনি কি গণনা ভুলে গেছেন? আমাদের ভাইয়েরা রক্তাক্ত হচ্ছে, আর তিনি এসি রুমে বসে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন!’ এদিকে দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালপ্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রশিবির। এতে আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত, দোষীদের গ্রেপ্তার ও ক্যাম্পাসে স্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। তাদের দাবি, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি রাখতে হবে।
দুই শিক্ষার্থী আইসিইউতে, একজনকে ঢাকায় স্থানান্তর : চবিতে সংঘর্ষে গুরুতর আহত ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের নাঈমুল ইসলামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সমাজতত্ত্ব বিভাগের মামুন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সায়েমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মামুনের মাথা ধারালো অস্ত্রের কোপে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং টানা চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে তাঁর মাথা থেকে হাড়ের টুকরো অপসারণ করতে হয়েছে। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার চবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে ভাসকুলার ইনজুরি হওয়ায় চবি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলামকে বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালের আইসিইউ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। তা ছাড়া ক্রেনিওটমি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন দুই শিক্ষার্থী। তাঁরা হলেন ইমতিয়াজ সায়েম (২৪) ও আবদুল্লাহ আল মামুন (২৩)। আর বর্তমানে চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন ১১ জন। অন্যদিকে রবিবার চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহত অসংখ্য শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে এসেছিলনে। এর মধ্যে কারও মাথা জখম, কারও শরীর রক্তাক্ত, কেউ হাতে কিংবা শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত।
৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিত : স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চবির পূর্বনির্ধারিত সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে চবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
তদন্ত কমিটি গঠন : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ২১ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে চবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিনকে। কমিটিতে সিন্ডিকেট সদস্য ও বিএনপি নেতা এস এম ফজলুল হক, ছাত্র প্রতিনিধিরা রয়েছেন। প্রসঙ্গত, ৩০ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় এক ছাত্রীকে হেনস্তার জেরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। টানা ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৩ শতাধিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেন কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।