বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের চাপের মুখে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তৈরি করা জুলাই জাতীয় সনদে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান ও আইনের ওপরে সনদের প্রাধান্য এবং সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রহিত করার অঙ্গীকারে বদল করা হয়েছে। বাতিল হয়েছে সনদের ব্যাখ্যার ক্ষমতা আপিল বিভাগকে দেওয়ার অঙ্গীকার। সনদে থাকছে না বাস্তবায়ন পদ্ধতি। আগামী সপ্তাহে বাস্তবায়নের কয়েকটি উপায় সুপারিশ আকারে সরকারকে দেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে কোন পদ্ধতিতে, কীভাবে সনদ বাস্তবায়ন হবে।
গতকাল রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ। শেষ মুহূর্তে সনদে ঘষামাজার কাজ শেষ করে কমিশন। এজন্য বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বৈঠক করেন কমিশনের সদস্যরা। বৈঠক শেষে কমিশন জানিয়েছে, সভায় জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া এবং তা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়। এ মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে আগামী সপ্তাহেই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন। এরপর চূড়ান্তকৃত সনদ ও বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ একসঙ্গে দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। বৈঠকে সনদের ভাষাগত যথার্থতাও পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েকটি বৈঠক করবেন। সেখানে সহযোগী হিসেবে থাকবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাই ১৫ সেপ্টেম্বর কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও পরে তা আবারও বাড়ানো হবে। যত দিন জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ও উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তবায়ন হবে না, তত দিন মেয়াদ থাকবে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সনদের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। চূড়ান্ত সনদ দুই খণ্ডের হবে। প্রথম খণ্ডে থাকবে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, যা সরকার প্রশাসনিক আদেশ বা অধ্যাদেশে অবিলম্বে কার্যকর করতে পারবে। দ্বিতীয় খণ্ডে যেসব সংস্কারের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং সব দলের ঐকমত্য হয়নি। কমিশনসংশ্লিষ্টরা জানান, পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় আট দফা অঙ্গীকারনামা ছিল। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দফার অঙ্গীকারে পরিবর্তন করা হয়েছে। বিশেষ করে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে সনদের অঙ্গীকারনামা অংশে। সনদে পূর্ণাঙ্গ খসড়ার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছিল, বিদ্যমান সংবিধান ও আইনে যা কিছুই বলা থাকুক, প্রাধান্য পাবে জুলাই সনদ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ওপরে সনদকে প্রাধান্য দিতে রাজি নয় বিএনপি। যদিও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এ অঙ্গীকারের সঙ্গে একমত। কমিশন সূত্র জানান, বিএনপিসহ কয়েকটি দল আপত্তি করায় সংবিধানের ওপর প্রাধান্য অঙ্গীকারে ভাষাগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সংস্কারের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধানাবলির চেয়ে প্রাধান্য পাবে সনদ। যেমন বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণ করার আইনি সুযোগ নেই। সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যতবার নির্বাচিত হবেন, ততবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন। কিন্তু সংস্কারের সুপারিশে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, এক ব্যক্তি জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় তা-ই থাকবে। বিদ্যমান বিধানের চেয়ে সনদের সুপারিশ প্রাধান্য পাবে। খসড়ায় চতুর্থ দফার অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, সনদের সুপারিশ ও প্রস্তাব সাংবিধানিকভাবে বলবৎ বলে গণ্য হবে। সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা ও জারির কর্তৃত্ব নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। জামায়াত, এনসিপি এতে একমত হলেও বিএনপি রাজি নয়। দলটি প্রথম দফায় দেওয়া মতামতে বলেছে, আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ হলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। কমিশন সূত্র জানিয়েছেন, এ অঙ্গীকারে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছে, সই করা কোনো দল সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। ১৬ জুলাই এ সনদ সই করার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। তবে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ না হওয়ায় সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, তাতে ঐকমত্য হলেও সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ও জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। বিএনপির অবস্থান হলো আইনবিধিসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। আর সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে আগামী জাতীয় সংসদে। জামায়াতে ইসলামী চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের (ঘোষণা) মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন। আর গণপরিষদ গঠন করে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সঙ্গে করার পক্ষে। এর পাশাপাশি যে ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে জুলাই সনদ তৈরি হচ্ছে, তার কয়েকটিতে বিএনপিসহ কিছু কিছু দলের ভিন্নমত আছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, উচ্চকক্ষে নির্বাচন পদ্ধতি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পদ্ধতির মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট আছে। এগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, সে প্রশ্নও এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। দলগুলোর সঙ্গে ২৩ দিন সংলাপ এবং দফায় দফায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠকেও এসব বিষয়ে সুরাহা হয়নি। দুই দফার সংলাপে দলগুলো ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের ৭৩টিতে একমত হয়েছে। ১১ মৌলিক সংস্কারের সুপারিশে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্টসহ (আপত্তি) সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঐকমত্য ঘোষণা করে কমিশন। এর ৯টিতেই বিএনপির আপত্তি। যার মধ্যে রয়েছে, পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং তিন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনে সুপারিশ।