রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নে চারটি প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এ নিয়ে আলাদা মতামত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। আগামী রবিবার বিকালে ফের আলোচনা হবে। জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি গতকাল দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। এদিকে আগামীকাল বিকাল ৫টার মধ্যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের জন্য প্রতিটি দলের পক্ষ থেকে দুজনের নাম চেয়েছে কমিশন।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হলেও তা সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। কমিশন সূত্র জানায়, দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞ প্যানেল একাধিক বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প বিবেচনা করে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচ পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করে। সেগুলো হচ্ছে-অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া। এ নিয়ে আলোচনাকালে সাংবিধানিক দিকগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সনদ বা এর কিছু অংশ নিয়ে গণভোট, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা বলে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠন করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পদক্ষেপ, ত্রয়োদশ সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভারূপে প্রতিষ্ঠা করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মতামত চাওয়া যে, যাতে বলা হবে অন্তর্বর্তী সরকার এ সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না। সর্বশেষ গণভোট, অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। সুপারিশের যেসব বিষয় সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয়, সেসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে পারে এবং সুপারিশের যেসব বিষয় সরকারি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ ও বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করতে পারে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশ জারি ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। জুলাই সনদের সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিষয়গুলো আগামী সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন চায় বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধান স্পর্শ করে না এমন সুপারিশগুলো নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। এগুলো সরকার এখনই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে এবং বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু যেগুলো সংবিধান সংশোধনের সম্পৃক্ত সেগুলো আগামী সংসদে করতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনী সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনি ইস্তেহারে উল্লেখ করবে। এরপর যারা ক্ষমতায় আসবে তারা সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। তিনি বলেন, সাংবিধানিক আদেশ জারির মধ্য দিয়ে এই সাংবিধানিক সংশোধনীগুলো এখনই কার্যকর করা যায় কি না, বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে সংবিধানের প্রোক্লেমেশন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের আদেশ দেওয়া যায়, যদি সংবিধান আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ যখন স্থগিত থাকে। তখন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এরকম প্রোক্লেমেশন জারি করা হয়। তিনি আরও বলেন, বিএনপি ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করবে না বলে যে সন্দেহ অনেকের মনে রয়েছে, তা অমূলক। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চায় জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের একটি যৌক্তিক সমাধান বের করতে হবে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সবকিছু জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। নতুন সংবিধান চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদের দুটি ভাগ রয়েছে। যেখানে একটিতে সংস্কার প্রস্তাব এবং অন্যটি বাস্তবায়ন পদ্ধতি। এর মাধ্যমে বাস্তবায়নে সংশয় দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো কিছুটা দুর্বলতা কাজ করছে। সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যে সুপারিশ গ্রহণ করেছি, তা বাস্তবায়ন করতে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে আগামী জাতীয় সংসদ। কারণ, সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই আমরা চলছি। সনদ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ হলে তা বিপজ্জনক হবে। এমনটি হলে ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি যে কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতে পারেন, যা আগামীতে নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিদ্যমান সংবিধানেই মৌলিক বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো। কমিশন যেসব প্রশ্নে এক হয়েছে, আগামী সংসদের প্রতিনিধিরা তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবেন, সে-সংক্রান্ত আইন করতে হবে। তিনি চান, আগামী সংসদ হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে; যারা দেশের মৌলিক সংস্কারের কাজ করবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনাও করবে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির ইউসুফ আশরাফ বলেন, বিশেষ সাংবিধানিক অধ্যাদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ, নির্বাচিত সরকার তা করবেন কি না অনিশ্চিত।