জুলাই গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এই মামলাটি এখন রায়ের পর্যায়ে। বিচারের শেষ পর্যায়ে রয়েছে আরও তিনটি মামলা। এর মধ্যে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুলের ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত প্রসিকিউশন পক্ষে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া আশুলিয়ার ঘটনায় ১৯ জন এবং রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ১১ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ মামলা তিনটির বিচার চলছে। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, এসব মামলা দ্রুত শেষ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। গণ অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে
গুমন্ডনির্যাতনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০টি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে গণ অভ্যুত্থানের আটটি এবং গুমন্ডনির্যাতনের দুটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ৯৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। ফর্মাল চার্জ দাখিল হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে বর্তমানে চারটি মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গ্রেপ্তার থাকা আসামিরা তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষী প্রদানের সুযোগ পাবেন। এর পর মামলাগুলো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে যাবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। প্রসিকিউশন থেকে জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত জুলাই-আগস্টের ঘটনা ও গুমন্ডনির্যাতনের ৪৫০টি অভিযোগ জমা পড়েছে ট্রাইব্যুনালে। এসব তথ্য প্রাথমিক যাচাইবাছাইয়ের পর ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হয়েছে ৩০টি। যেসব মিস কেস তদন্তাধীন আছে, তার মধ্যে একটিতে আসামির তালিকায় আছেন ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, জুনাইদ আহ?মেদ পলকসহ ৪৫ জন। এ মামলায় প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য রয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো ঘটনায় বা অভিযোগে প্রথমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বা তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে তা ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হিসেবে ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত হয়। এরপর তদন্ত সংস্থা ওই অভিযোগের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। এই ফর্মাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমেই মিস কেস মামলায় রূপ নেয়। জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক ও জুনায়েদ আহমেদ পলকের বিষয়ে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগিরই আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে।
তিনি বলেন, বিচার চলমান থাকা মামলাগুলোও বিলম্ব ছাড়া শেষ হবে। এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। গুমের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, এগুলোর বিচারও শেষ হবে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে চার মামলায় : গণ অভ্যুত্থানের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা মামলাগুলোর মধ্যে বর্তমানে চারটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এর মধ্যে চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে হত্যা ঘটনায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ আটজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় এরই মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ মামলায় হাবিব ছাড়াও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই পলাতক। বাকি চার আসামি শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের উপস্থিতিতে বিচার চলছে।
আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় এখন পর্যন্ত ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। এ মামলায় আসামি ১৬ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশের সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহিদুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক এবং সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। পলাতক আছেন সাবেক এমপি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান রিপন, আশুলিয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এফ এম সায়েদ, পরিদর্শক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, পরিদর্শক নির্মল কুমার দাস, এএসআই বিশ্বজিৎ সাহা ও যুবলীগের কর্মী রনি ভূঁইয়া। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের প্রথম মৃত্যুবরণ করা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ মামলায় আসামি ৩০ জন। এর মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টে রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়ও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। গত বুধবার এই মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন গুলিবিদ্ধ আমির হোসেন। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ এই মামলায় মোট আসামি পাঁচজন। এর মধ্যে একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত আসামি রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার।