মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
জেনে রাখা ভালো

নিপাহ ভাইরাস নিয়ে কিছু কথা

ডা. অভিষেক ভদ্র

নিপাহ ভাইরাস নিয়ে কিছু কথা

শীত মানেই খেজুর রসের ঘ্রাণে ভরে যাওয়া গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি। চারদিকে শুরু হয় খেজুর রস আর গুড় দিয়ে হরেক রকমের পিঠাপুলি তৈরির ধুম। গ্রাম্য সংস্কৃতির এ ছোঁয়া পেতে উতলা হয় নগরবাসীও। গাছিদের ব্যস্ততাও তাই বাড়ে। সন্ধ্যা হলেই খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধতে ব্যস্ত তারা। সকাল হতে না হতেই রসে টইটম্বুর হয়ে যায় সেই হাঁড়িগুলো। আর তখন সবাই মিলে সেই রসের স্বাদ নেওয়ার বিষয়টি অতুলনীয়। তবে শুধু মানুষই নয়, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির পাখপাখালিরাও মেতে ওঠে খেজুর রসের স্বাদ আস্বাদনে। আর বিপত্তিটা ঘটে সেখানেই! নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো পাখি বিশেষ করে বাদুড় যখন গাছে থাকা রসের হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে তখন তার লালা রসের সঙ্গে মিশে যায়। আর সেই লালা বা মলমূত্র মিশ্রিত রস পানের মাধ্যমে মানুষের শরীরে নিপাহ ভাইরাস প্রবেশ করে। শুধু খেজুর রস নয়, পশুপাখির আধাখাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও মানব শরীরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। মনে রাখতে হবে, বাদুড় এ ভাইরাস বহন করলেও তারা এতে আক্রান্ত হয় না। বাদুড় থেকে মানুষ আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত মানুষের মাধ্যমে অন্য মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশ নিপাহ ভাইরাস : বিশ্বে হাতেগোনা যে কয়েকটি দেশে নিয়মিতভাবে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অতি সম্প্রতি ২০২৩ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর গবেষণা মতে, দেশে নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুহার ৭১%। ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ৩২৬ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে মারা গেছেন ২৩১ জন। অর্থাৎ দেশে এ ভাইরাসে ১০০ জন আক্রান্ত হলে ৭১ জন মারা যাচ্ছেন। দেশে ২০০১ সালে প্রথম মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত ৩২ জেলায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালে লালমনিরহাট জেলায় ২২ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন মারা যায়। বাংলাদেশের মেহেরপুরে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০০১ সালে প্রথম এ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর শীতকালে বাংলাদেশের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো, বিশেষ করে মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, নাটোর, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, মাদারীপুর, লালমনিরহাট, জয়পুরহাটে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়।

রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা : রোগীর রক্ত, প্রস্রাব, স্নায়ুতন্ত্রের তরল (সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড) ইত্যাদি শারীরিক তরল থেকে পিসিআর, অ্যান্টিবডি টেস্ট, এলাইজা, সেল কালচার দ্বারা ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা যায়। রোগ থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করা যায়, যা পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

চিকিৎসা : সাধারণত অন্যান্য ভাইরাসবাহিত রোগের ন্যায় এ রোগের এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়, প্রয়োজনে অ্যান্টিভাইরাল ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া জটিলতার লক্ষণগুলো দেখা দিলে যেমন এ সময়ে (ডিসেম্বর-এপ্রিল) যে কোনো রোগী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট বা অজ্ঞান হলে দেরি না করে নিকটস্থ রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, প্রয়োজনে আইসিইউও লাগতে পারে। আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অপরদিকে আরও একটি জরুরি সতর্কতার দিক হচ্ছে- শুধু রোগী নয়, রোগে আক্রান্তদের পরিচর্যাকারীদেরও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

রোগ প্রতিরোধে করণীয় : খেজুরের কাঁচা রস পান করা উচিত নয়। তবে রস দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস অর্থাৎ রস আগুনের উত্তাপে রান্না হওয়ার পর তৈরি সব খাবার খাওয়া যেতে পারে। আর কাঁচা রস যদি খেতেই হয় তবে গাছ থেকে খেঁজুরের রস সংগ্রহের হাঁড়ি ঢেকে রাখতে হবে, যাতে করে কোনো পাখির সংস্পর্শে তা না আসে। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল না খাওয়াই ভালো। ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা উত্তম। এসব ব্যবহৃত যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, সম্ভব হলে মাটিচাপা দিতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।

সাবধানতা : এ রোগের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি।

* যেহেতু নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়, তাই নিকট সময়ে যারা খেজুরের রস খেয়েছেন তাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

* আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। তাই যারা রোগীদের সেবা দিয়েছেন এবং মৃতদের সৎকার করেছেন তাদের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

* রোগীর সঙ্গে একই পাত্রে খাওয়া বা একই বিছানায় ঘুমানো যাবে না।

* রোগীর ব্যবহৃত কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

* রোগীর শুশ্রƒষা করার সময় মুখে কাপড়ের মাস্ক, হাতে গ্লাভস পড়ে নিতে হবে।

* যে এলাকা নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হওয়ার পর আরও অন্তত ২১ দিন পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে। তাই এ বিষয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রভাষক, পপুলার মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর