একসময় ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা বনগুলোতে প্রচুর ময়ূর বাস করত। পেখম তুলে ‘কেক-কি-ওয়াওকি-ওয়াওকি-ওয়াও’ আওয়াজে মাতিয়ে তুলত বন। মানুষের শিকারের নেশা, রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার, বন উজাড়ের আজ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে দৃষ্টিনন্দন পাখিটি। গত ১০০ বছরের মধ্যে প্রকৃতিতে মাত্র একবারই ময়ূরের দেখা মিলেছিল মধুপুর জাতীয় উদ্যানে ১৯৮২ সালে। এখন শুধু চিড়িয়াখানা আর সাফারি পার্কেই ধুকে ধুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পাখিটি।
শুধু ময়ূরই নয়, বাদা তিতির, খৈর বা মেটে তিতির, লালগলা বাতই, গোলাপি শির হাঁস, বাদি হাঁস, সারস, বাংলা ডাহুর, পাতি ডাহুর, হাড়গিলা বা বড় মদনটাক, চিতিঠোঁট গগণবেড়, ফ্যাকাশে মাথা কবুতর, ধলা পেট বক, ছিটিথুটি গগণবার, দাগিলেজ গাছ আছড়া, লালমুখ দাগিডানা, কালাবুক টিয়াথুটি, লালমাথা টিয়াথুটি, তিলাবুক টিয়াথুটি বা রাজ শকুনের মতো পাখিগুলোকেও আর দেখা যায় না প্রকৃতিতে। দেখা তো দূরের কথা, এসব পাখির নামও জানে না নতুন প্রজন্মের অনেকে। অথচ, এক সময় বাংলার মাঠঘাট, বনবাদাড় মাতিয়ে রাখত এসব পাখি। সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসত কিচিরমিচির, কুহু কুহু, কিউই কিউই, কুউউ ঝি ঝি ঝি-এমন হরেক রকমের ডাক। বনবিভাগ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইইউসিএন) কর্তৃক প্রকাশিত লাল তালিকায় পাখিগুলোকে স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে গোলাপি শির হাঁস পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ, গত ১০০ বছরের মধ্যে পাখিটিকে কোথাও দেখা যায়নি।
তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিযায়ীসহ বাংলাদেশে সাত শতাধিক প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। এর মধ্যে ১৬৬ বছর পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুডাইংয়ে দেখা মিলেছে ক্র্যাক বা ইৎড়হি ঈৎধশব নামের পাখির। তাই কিছু পাখি বিলুপ্ত হলেও আবার ফিরে আসছে। তবে হারিয়ে যাওয়ার সংখ্যাই বেশি। ২০১৫ সালে আইইউসিএনের সমীক্ষায় বাংলাদেশে পাখি পাওয়া যায় ৫৬৬ প্রজাতির। এর মধ্যে ১৯ প্রজাতির পাখিকে স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংস্থাটির মতে বিলুপ্ত পাখি তিন ধরনের। যে পাখি পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে সেগুলো বিলুপ্ত, যেগুলো প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেলেও আবদ্ধ অবস্থায় (যেমন : চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্কে) বেঁচে আছে, সেগুলো বুনো অবস্থায় বিলুপ্ত এবং যেগুলো বিশ্বের কোনো এক স্থানে বিলুপ্ত হলেও অন্য স্থানে বেঁচে আছে, সেগুলো স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত বলা হয়। এ ছাড়া বিলুপ্ত না হলেও সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে আরও অনেক পাখি। জাতীয় পাখি দোয়েলের দেখা মেলাও এখন দুষ্কর। বসন্তে এখন আর কোকিলের ডাক তেমন একটা শোনা যায় না। ভেসে আসে না ‘বউ কথা কও’ পাখির মিষ্টি সুর। কমে যাচ্ছে প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত শকুনের সংখ্যাও। বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে ৫০ হাজারের বেশি শকুন ছিল। বনবিভাগ ও আইইউসিএনের ২০২৩ সালের শুমারিতে ২৬৭টি শকুনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ হবিগঞ্জ কার্যালয়ের রেঞ্জ কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী জানান, ‘বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ২১০টি শকুন বেঁচে আছে।’ গবেষকদের মতে, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৯০% শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আইইউসিএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪২৪ প্রজাতির পাখি নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন সমস্যা দেখা যায়নি। তবে মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে ১০টি প্রজাতি, বিপন্ন অবস্থায় আছে আরও ১২টি ও সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে ১৭টি প্রজাতি। এ ছাড়া শঙ্কাগ্রস্ত বা অচিরেই ঝুঁকিতে পড়তে পারে এমন অবস্থায় আছে ২৯টি প্রজাতি। ৫৫ প্রজাতির পাখির ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
পাখি বিলুপ্তির পেছনে আবাসস্থল ধ্বংস, বন উজাড়, জলাভূমি ও চারণভূমি হারানো, পানি ও বায়ুদূষণ, প্লাস্টিকদূষণ, কীটনাশকের ব্যবহার, পাখি শিকার ও পাচার, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রজনন ও খাদ্যচক্রে বিঘ্ন ঘটানোকে মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়। এ ছাড়া চিল, বাজপাখি ও শকুন কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি পাখি হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলো বন্ধ ও পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা না যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক পাখির কণ্ঠ চিরতরে থেমে যাবে।