অ্যান্টার্কটিকার মাকমার্ড ড্রাই ভ্যালিজ অঞ্চলে অবস্থিত ‘রক্তঝরা হিমবাহ’ পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি। এই হিমবাহ থেকে যে লালচে রঙের পানি প্রবাহিত হয়, তা প্রথম দেখলে মনে হয় যেন বরফ থেকে রক্ত ঝরছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি রক্ত নয়, বরং একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলাফল, যা আয়রন অক্সাইডের কারণে পানিকে লালচে রং দেয়।
এ ঘটনাটির পেছনে মূল কারণ হলো বরফের নিচে আটকে থাকা লবণাক্ত পানি, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এই পানি অত্যন্ত লবণাক্ত এবং অক্সিজেনহীন, যার ফলে তাতে থাকা আয়রন দীর্ঘ সময় ধরে অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া না করে অবস্থান করে। বরফের চাপের কারণে এই পানি সম্পূর্ণরূপে বদ্ধ অবস্থায় রয়েছে এবং সাধারণত বাষ্পীভবন বা মিশ্রণের সুযোগ পায় না। এই লবণাক্ত পানি বরফের ফাটল দিয়ে বাইরে বের হলে তা বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে। এ পর্যায়ে পানির মধ্যে থাকা আয়রন অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আয়রন অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়, যা পানিকে গাঢ় লাল বা বাদামি রং দেয়। এভাবেই বরফ থেকে বের হওয়া এই পানি দেখতে ‘রক্তপাত’র মতো লাগে। এই লাল রং প্রকৃতিতে অন্য কোথাও এত স্পষ্টভাবে দেখা যায় না, তাই এটি বিশেষভাবে নজর কাড়ে। ‘রক্তাক্ত হিমবাহের এই বিশেষ প্রাকৃতিক অবস্থা শুধু ভূতাত্ত্বিক নয়, জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পানিতে একপ্রকার মাইক্রোবিয়াল জীবন বিদ্যমান রয়েছে, যা অক্সিজেনহীন বা অত্যন্ত সীমিত অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখে। এ ধরনের জীবাণু পৃথিবীর বিভিন্ন চরম পরিবেশে যেমন গভীর সমুদ্রের তলদেশ বা সোলার জীববিজ্ঞানের জন্য মঙ্গল গ্রহের অনুরূপ পরিবেশে জীবন খোঁজার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
অ্যান্টার্কটিকায় এই হিমবাহের আবিষ্কার এবং গবেষণা আমাদের কঠিন পরিবেশে কীভাবে রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জীবনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, তা বুঝতে সাহায্য করে। এটি মহাকাশ জীববিজ্ঞানে এমন পরিবেশে জীবন থাকার সম্ভাবনা অন্বেষণের জন্য মডেল হিসেবেও বিবেচিত হয়। এ ছাড়া এই ঘটনার মাধ্যমে জানা যায় যে, পৃথিবীর অক্সিজেনহীন জায়গায়ও আয়রন এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের বিক্রিয়া চলতে পারে এবং জীবন ধারণের মতো প্রক্রিয়া সম্ভব।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়